• ঢাকা, বাংলাদেশ বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৭ অপরাহ্ন
  • [কনভাটার]
শিরোনামঃ
আইসিবিআই ব্যাংকের এসভিপি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান হলেন বাঁশখালীর মান্নান আশরাফ ফকির হত্যা: অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা, স্ত্রী-ছেলে কারাগারে হাটহাজারীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিশ্ব মঞ্চে মোহাম্মদ ইকবাল বিএনপি ক্ষমতায় আসলে দেড় বছরে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করা হবে : আমীর খসরু ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় বাঁশখালীর যুবকের মৃত্যু বিএনপির প্রার্থী তালিকায় অনুপস্থিত শীর্ষ নেতারা এনসিপির দক্ষিণ জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী হলেন বাঁশখালীর মিশকাত বাঁশখালী নিয়ে লেয়াকত আলীর ধারাবাহিক লেখনী ভাইরাল হযরত শাহ জাহাঁগীর তাজুল আরেফীন কঃ – প্রেমের বাদশাহর রাজকীয় উপাখ্যান বাঁশখালীতে গণঅধিকারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা; গণমানুষের নেতা অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ

রিপোর্টার নাম: / ৪৩ শেয়ার
আপডেট: বুধবার, ২৮ মে, ২০২৫

রহিম সৈকত

কাথরিয়া বাগমারা উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে বিদ্যালয়ের দেয়ালে সাটানো প্রফেসর সাহেবের স্মরণ সভার পোস্টারের মাধ্যমে প্রফেসর সাহেবের সাথে পরিচয়। সেসময় দেয়ালে, সাইনবোর্ডে, চলার পথে পাঠযোগ্য যা যা পড়ত সেসব ছিল আমার নিত্য আলোচনা, গবেষনার বস্তু। আর আমার এসব কৌতুহল নিয়ে খুব ত্যক্ত করতাম ছোট মামা, নানাদের ( নজরুল, কাশেম (বর্তমানে দুজনেই শিক্ষক), ছোট নানা আবুল ফজল আগ্রহ নিয়ে আমার কৌতুহল মেটাতেন। এভাবেই প্রফেসর সাহেব মানসপটে গেঁথে যায়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান নিয়েও কৃষক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। মাথায় হুলিয়া নিয়ে এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন। এমনও সময় গেছে কৃষকদের নিয়ে সমাবেশ করছেন হঠাৎ পুলিশ সেখান হাজির। পুলিশ ভ্যাবাচেকা খাইত কারন সেখানে কোন নেতা নেই সব খেটে খাওয়া ছিন্নবস্ত্রের কৃষক। এত বড় নেতস আবার তিন প্রফেসরও, তিনি যে কৃষকের বেশভূষায় থাকবেন তা পুলিশের ছিল কল্পনাতীত।

আসহাব উদ্দিন আহমদ এর একমাত্র পুত্র সন্তান প্রয়াত এন্তেজার উদ্দিন আহমদ

আরেকটি ঘটনার স্মৃতিচারণ কিরতে গিয়ে নানা বলেন, একদিন গোপনসূত্রে খবর নিয়ে কোন এক কৃষকের বাড়ি ঘেরাও কিরে ফেললেন, এইবার প্রফেসের সাহেব ধরা পড়বেনই পড়বেন। পুলিশ মার্চ করে কৃষকের বাড়িতেচপ্রবেশ কিরছেন পাশ দিয়ে গোল গলার মলিন ছিন্ন গেঞ্জি পরিহিত এক লোক লুঙ্গি মালকোঁচা দিয়ে গোবরের ভার নিয়ে পুলিশের পাশ দিয়ে হেটে চলে যাচ্ছিল ভাবলেশহীন ভাবে। পুলিশ কল্পনাও করতে পারেনি তাঁদের শিকার তাঁদের পাশ দিয়ে হেটে চলে যাচ্ছেন। এভাবেই তিনি দিনের পর দিন মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন, মানুষকে মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেন প্রফেসর সাহেবের দৌহিত্র প্রফেসর বশির উদ্দিন কনক বলেন, ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় বর্তমান মোজাহেরুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকায় একটি এতীমখানার তিদারকিও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। এতগুলো এতীম ছেলেমেয়ের জন্য খাবারের সংস্থান কীভাবে করবেন এমন চিন্তায় বেশিরভাগ অস্থির থাকতেন।

২০১০ সাল, সেসময়ের জনপ্রিয় স্মার্টফোন নকিয়া ই-৭২ হাতে পাওয়ার পর, ফনিক্স সাইকেলটা নিয়ে বাঁশখালীর এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত আমার ছুটে চলা। নিজ জন্মভূমির খুটিনাটি আমি তুলে ধরছি আমার প্ল্যাটফর্ম অপরুপ বাঁশখালী ফেসবুক পাতায়। সেবছর ছুটে যাই প্রফেসর আসহাব উদ্দিন আহমেদ এর স্মৃতিধন্য ভিটেমাটিতে। স্যারের সন্তান এন্তেজার উদ্দিন আহমেদ, আমাকে পেয়ে অনেক খুশি। আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্যারের স্মৃতিচিহ্ন দেখালেন। স্যারের হাতে লেখা মূল্যবান একটা দিনলিপি উপহার দিলেন, সাথে দুষ্প্রাপ্য কিছু বই। ডায়েরির পাতা ছুয়ে মনে হচ্ছিল আমি ১৯৭৩ ছুঁয়ে দেখছি, আমি কিংবদন্তী আসহাব উদ্দিন আহমদকে ছুঁয়ে দেখছি। স্বহস্তে লেখা এপিটাফ দেখে বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল মন। এপিটাফটির ছবি তুলে রাখলাম আজও ধিরে রেখেছে যত্নে, আদরে, ভালবাসায়। কী ছিল তাতে?

প্রফেসর আসহাব উদ্দিন আহমেদ এর স্বহস্তে লিখিত শেষ ইচ্ছাপত্র

শেষ ইচ্ছাপত্র: সমস্ত তনু-মন-প্রাণ, সমগ্র জীবন দিয়ে ভালবেসেছিলাম জননী জন্মভূমির নীল আকাশ, শীতল বাতাস, সবুজ বনানী, শ্যামল প্রান্তর আর তরঙ্গচঞ্চলা নদী-সাগরকে। আর তেমনি ভালবেসেছিলাম এই সুন্দর প্রকৃতির লীলা নিকেতনে বসবাসকারী দারিদ্রমলিন অসুন্দর জীবনযাপনকারী শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্চিত ভাগ্যহত মেহনতী মানুষদের। সারা জীবন চেয়েছি তাদের শোষণমুক্ত করে মানবেতর স্তর থেকে সর্বাঙ্গসুন্দর উন্নত মানুষের স্তরে টেনে তুলতে। কিন্তু যত সাধ তত সাধ্য ছিল না তাই বিদায়লগ্নে আমি সাফল্যের তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছি। তবে বুকভরা এই আশা নিয়ে যাচ্ছি যে যোগ্য পরবর্তীরা অযোগ্যের কাজকে এগিয়ে নেবেন এবং তাকে সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছিয়ে দেবেন।”

অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ এক কিংবদন্তির নাম; ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও সমাজচিন্তক। তিনি তাঁর বহুমাত্রিক জীবন ও কর্ম দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য, রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক জগতে এক বলিষ্ঠ উপস্থিতি রেখে গেছেন। মানুষের মুক্তি ও সামাজিক পরিবর্তন ছিল তাঁর জীবনের মূল চালিকাশক্তি। তাঁর মৃত্যুর কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও আজকের সমাজে তিনি হয়ে উঠেছেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।

২০০৫ সালে তৎকালীন সরকার প্রধান বেগম খালেদা জিয়া তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করেন।

 

আসহাবউদ্দীন আহমদ ১৯১৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামের এক সচ্ছল কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুনশী সফর আলী চৌধুরী ও মাতা নাসিমা খাতুন। ১৯৩২ সালে তিনি বাণীগ্রাম-সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৩৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৩৬ সালে বিএ পাস করেন। সর্বশেষে ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

স্বহস্তে লিখিত ডায়েরির পাতা

 

শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ, ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মুহসীন কলেজ), লাকসাম নবাব ফয়েজুন্নেসা কলেজ, ফেনী সরকারি কলেজ এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে থাকাকালে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তিনি ‘প্রগতি মজলিশ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল মুসলিম লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী মাধ্যম।

 

এই সময় তাঁর সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেন অধ্যাপক আবুল খায়ের, যিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একজন প্রগতিশীল শিক্ষক ছিলেন। এ সময় ড. আখতার হামিদ খান তাঁর ও অন্যান্য সহকর্মীদের রক্ষা করেন প্রশাসনিক চাপ থেকে। এর মধ্য দিয়েই আসহাবউদ্দীনের চিন্তাধারায় রাজনীতির গভীর প্রতিফলন ঘটে এবং তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর তিনি শিক্ষকতা ছাড়েন এবং কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী লীগের (ন্যাপ) সাধারণ সম্পাদক হন। পাকিস্তান আমলে বিপ্লবী রাজনীতির কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয় এবং একাধিকবার আত্মগোপনে থাকতে হয়।

 

১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে তিনি পিকিংপন্থী অংশের সঙ্গে যুক্ত হন এবং চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে গণচীন সফর করেন। পরবর্তীতে রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও কৃষক-শ্রমিকদের পাশে থেকে কাজ চালিয়ে যান।

 

রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য ছিল আসহাবউদ্দীনের অন্যতম প্রিয় ক্ষেত্র। তাঁর মতে, সাহিত্যের মাধ্যমেও মানুষকে সচেতন করা সম্ভব। ১৯৪৯ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ “বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর” প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি শোষণ, বৈষম্য, দুর্নীতি, কুসংস্কার ও সমাজ পরিবর্তন বিষয়ে ২৭টির অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখায় ছিল ব্যঙ্গ-রসের ছোঁয়া, যা রাজনৈতিক বাস্তবতাকে হাস্যরসের ভেতর দিয়ে জনমানসে প্রবেশ করাতে সক্ষম হতো।

 

তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: “ধার”, “উদ্ধার”, “হাতের পাঁচ আঙুল”, “বন্দে ভোটরম্”, “আওয়ামী লীগের মীর জাফরী ঐতিহ্য”, “লেখক ও পাচক”, “ভাতের বাংলা কাপড়ের বাংলা”, “শিকল ভাঙার গান”, “দ্বিপদ বনাম চতুষ্পদ”, এবং “লাথি লাঠি গণতন্ত্র”। তিনি লেখালেখির মাধ্যমে জনগণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন—প্রচারণার ভাষায় নয়, সাহিত্যের রূপে।

 

সাহিত্য ও সমাজের জন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আসহাবউদ্দীন আহমদ ২০০৫ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি বৌদ্ধ একাডেমি পদক, অনুপম পদক, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ পদক, আইনজীবি সমিতি পদক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের পদকে সম্মানিত হন।

 

১৯৯৪ সালের ২৮ মে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ডিগ্রী কলেজ প্রাঙ্গণে তাঁর প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সমাহিত করা হয়।

 

আজ তাঁর ২৬তম প্রয়াণ দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে তাঁর রচনাবলীর দুষ্প্রাপ্যতার কারণে নতুন প্রজন্মের পাঠকরা তাঁর সম্পর্কে জানার সুযোগ পাচ্ছেন না, ফলে ধীরে ধীরে তিনি বিস্মৃত হচ্ছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, বিশেষত তাঁদের জন্য, যারা রাজনীতি, সাহিত্য ও সমাজ পরিবর্তনের জন্য একযোগে সংগ্রাম করতে চান।

অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদের জীবন এক দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস—অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন সমাজ পরিবর্তনের কবি, রাজনীতির যোদ্ধা, এবং সাহিত্যের রসিক কারিগর। নতুন প্রজন্মের পাঠকদের উচিত তাঁর কর্ম ও সাহিত্য পুনরাবিষ্কার করে আগামীর পথে আলোর দিশা খোঁজা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটেগরিতে আরো নিউজ
সিবি হসপিটাল কী? কেন? কিভাবে?