আলমগীর মোহাম্মদ ◾
“একজন জ্যোতির্বিদ ( শিক্ষক) তোমার সাথে মহাকাশ সম্পর্কে তাঁর অর্জিত বিদ্যা নিয়ে কথা বলতে পারবেন, কিন্তু তোমাকে সেই বিদ্যা দান করতে পারবেন না।” লেবাননের কবি খলিল জিবরান যথার্থই বলেছেন। শিক্ষকের কাজ হলো পথ দেখানো, শিক্ষার্থীর মন বুঝার চেষ্টা করা এবং জ্ঞানের পথে উৎসাহিত করা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা ঠিক এরকম শিক্ষকের সাক্ষাৎ বর্তমানে খুব একটা পাই না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন শিক্ষকের চেয়ে কর্মীর সংখ্যা বেশি।
আমাদের পরিবারে পড়ালেখা করা তেমন কেউ ছিল না। আমি নানার বাড়িতে থাকতাম। আমার নানা, যাকে আমি আমার প্রথম শিক্ষক মানি, তিনি সাত ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলেন। কথাবার্তায় উইটি ছিলেন। তাঁর জীবন দর্শন আমাকে প্রভাবিত করেছে। নানী পড়ালেখা জানতেন না। তবে নানার কথামতো আমাকে পড়ালেখায় উৎসাহ দিতেন। এরকম একটা পরিবারে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা সাধারণত বেশিদূর পড়ালেখা এগিয়ে নিতে পারে না। আমার ভাগ্য ভালো আমি কিছু আদর্শ শিক্ষক পেয়েছিলাম জীবনের শুরুতে। যারা আমার মধ্যে বীজ বপন করে দিয়েছিলেন পড়ার, পড়ানোর।
আমাদের সময়ে শিশু শ্রেণীতে ক্লাস নিতেন পশ্চিম গুনাগরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নন্দিতা দাস। তিনি বাঁশখালীর প্রথম প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। ম্যাডাম সুন্দর উচ্চারণে আমাদেরকে বর্ণমালা পড়াতেন। ল্যাংগুয়েজ টিচিংয়ে ড্রিলের ব্যবহার আছে। ম্যাডাম সেটাই কার্যকরভাবে ব্যবহার করতেন। স্কুলের বারান্দায় অথবা বড় একটা ক্লাসরুমে আমাদেরকে নিয়ে বসতেন ম্যাডাম। স্লেইটে অক্ষর লেখা শেখাতেন। সংখ্যা, নামতা, যোগ, ভাগ, বিয়োগ, গুণ। মাঝেমধ্যে ম্যাডাম গান করতেন। ” এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা, সুরমা নদীর…” ছড়া পড়তেন জোরে জোরে। আমি মোটামুটি রেস্পন্স করতাম। তাই ম্যাডাম আমাকে চিনতেন। ক্লাসে ওয়ানে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম ম্যাডামের সামনে। নাম লিখতে দিয়েছিলেন। ব্যস!
ম্যাডাম ওয়ানে আমাদেরকে সংখ্যা পড়াতেন। আমার রোল ছিল ছাপ্পান্ন। ক্লাস টুতে গিয়ে সেটা নয়, থ্রিতে গিয়ে তিন, বাকি দুই বছর এক। রেজাল্টের দিন ম্যাডামের কাছে গিয়ে বলে আসতাম। ম্যাডাম বিস্কিট খেতে দিতেন। দুপুর বেলায় নিজের টিফিন বক্সের ঢাকনায় করে ভাত খেতে দিতেন। পড়ার বিনিময়ে খাদ্য। বিজ্ঞান পড়াতেন ফোর -ফাইভে। একবার এক স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার, গাছ বুঝলাম। পালা কি বুঝলাম না। পালা অর্থ কি জানতে চাইলে স্যার আমাকে রামধোলাই দিয়েছিলেন। এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম রোগ্। প্রশ্ন করলে তাঁকে বসিয়ে দেওয়া হবে। সেটা যেভাবে হোক। হয় পিঠে দিয়ে, না হয় পেটে লাথি দিয়ে। ম্যাডাম পরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পালা কী।
একবার স্কাউটে যাব উপজেলায়। আমাদের ড্রেস নেই। স্যাররা কতগুলো নিয়ে আসলেন। আমরা ইন করে প’রতে জানতাম না। ম্যাডাম আমাদের সবাইকে নিজ হাতে প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। স্কাউটে একটা গেইম ছিলো পানিভর্তি বালতি থেকে কামড়ে আপেল তোলা। আমি কামড়ে এক টুকরো তুলতে পেরেছিলাম। স্যাররা সেটা অবশ্যই সেটা খেতে না দিয়ে ফেলে দিয়েছিলে। মনেমনে খারাপ লাগছিল খুব। আপেল খাওয়ার জন্য৷ বন্ধুদের বলছিলাম আপেল খাওয়ার ইচ্ছের কথা। ম্যাডাম দূর থেকে শুনে ফেরার পথে আপেল কিনে দিয়েছিলেন সবাইকে। আরেকটা ঘটনা মনে আছে। একবার আমি দীর্ঘদিন স্কুলে যেতে পারিনি। মুসলমানি করিয়েছিল। সাথে কি একটা অসুখে সতের দিন স্কুলে যেতে পারিনি। ম্যাডাম খবর নিয়ে নানার বাড়ি চলে এসেছিলেন। শেষেরটা মজার অভিজ্ঞতা। দুই হাজার এক সালে সংসদ নির্বাচন জমজমাট হয়েছিল। তখন ফাইভে পড়ি। এখনকার মতো রাতে ভোট হতো না তখন। তাই সর্বসাধারণের আগ্রহ ছিল দেখার মতো। তো, একটা মিছিলের পেছনে আমি হাঁটতে হাঁটতে দশ কিলোমিটার দূরে উপজেলায় চলে গিয়েছিলাম। ঢোলের বারির সাথে মানুষের উল্লাস আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অতটুকু পথ। সেখানে ভাগ্যক্রমে নানা ভাইয়ের দেখা পেয়েছিলাম। দুজন তাঁর শ্যালিকার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম রাতে। তখন ফোনের যুগ না। এদিকে বাড়িতে খোঁজাখুঁজি পড়ে গেছে। ফেরার পথে আমি সোজা স্কুলে চলে গিয়েছিলাম। স্কুলের মাঠের পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক লোকের পেপার পড়া দেখছিলাম উঁকি দিয়ে। পেছন থেকে ম্যাডাম এসে কলার ধরে নিয়ে গেলেন অফিসে। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। পরে জানতে পারলাম ম্যাডাম শুনেছেন আমি হারিয়ে গেছি। বেতের বারিতে সেদিন মোটামুটি লাল করে ছেড়েছিলেন আমাকে।
নন্দিতা ম্যাডাম খুব অমায়িক মানুষ ছিলেন। আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া পরিবারের সন্তানদের জন্য ম্যাডাম ছিলেন ভরসাস্থল। ম্যাডাম না হলে আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেতে পারতো। অনেকের তাই হয়েছিল। তিনি আমাকে আগলে রেখেছিলেন। ক্লাস ফাইভ শেষে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। সেদিন প্রথম দেখলাম কারো প্রতি শুভকামনা কিভাবে জানাতে হয়। ম্যাডাম হাতে লেখা টিসিতে লিখে দিয়েছিলেন আমি তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। হাইস্কুলে পড়ার সময় ম্যাডামকে খুব একটা দেখিনি। তিনি অবসর গ্রহণ করেছিলেন। মেয়ের সাথে থাকতেন শহরের বাসায়।
অনেক বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শহরের রাস্তায় একবার ম্যাডামের সাথে দেখা হয়েছিল। সালাম দিলাম। বললেন, ‘আমার সাথে আসো।’ কতদূর যাওয়ার পর জানতে চাইলাম, ম্যাডাম আমাকে চিনতে পেরেছেন? কিছু না বলে হাঁটতে বললেন। রাহাত্তারপুল একটা বাসায় উঠলাম ম্যাডামের সাথে। সেখানে গিয়ে দেখি ওটা ম্যাডামের মেয়ের বাসা। দিদি এখন চবির সহযোগী অধ্যাপক। তখন বিজিসিতে পড়াতেন। ম্যাডাম আমার নানা- নানি, ছোটখালা সবার কথা জিজ্ঞেস করলেন। বাসায় নিয়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম শুনে দিদির সাথে দেখা করানোর জন্য বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। সেই থেকে শ্রাবনী মল্লিক দিদি আমাদের আপনজন হয়ে ওঠলেন।
ম্যাডামের সাথে আর দেখা হয়নি। প্রিমিয়ারে দিদি দুইটা কোর্স পড়াতেন। দেখা হলেই ম্যাডামের কথা জানতে চাইতাম। যাব যাব করে আর দেখা করা হয়নি। ম্যাডাম বছর দুয়েক আগে পরলোকগত হন। একজন আন্তরিক, সজ্জন, শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক ছিলেন নন্দিতা দাস। বাঁশখালীর একটা গ্রামের স্কুলে সারাজীবন পড়িয়েছিলেন। আমার মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অক্ষরজ্ঞান লাভে সহায়তা করেছিলেন। ম্যাডাম আমাদেরকে শিষ্টাচার শিখিয়েছিলেন। অপরিচিতজনকে আপনি বলা, বড়দেরকে সালাম দেওয়া, ছোটদের সাথে রূঢ় না হওয়া, অন্য ধর্মের মানুষকে ব্যঙ্গ না করা, কারো অনিষ্ট না করা, নিজের প্রতি সৎ থাকা ইত্যাদি নীতিকথা ম্যাডাম আমাদেরকে শিখিয়েছিলেন। নন্দিতা ম্যাডাম একজন সফল মা। সফল শিক্ষক। তাঁর সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, ছাত্রও। আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসে নন্দিতা দাস ম্যাডামের মতো আন্তরিক শিক্ষকদের সালাম জানাই।
লেখক; শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ
বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা।