গ্রামাঞ্চলে বিষাক্ত সাপের কামড় মানেই মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। চোখের সামনেই প্রিয় মানুষটি ছটফট ছটফট করতেই নিথর হয়ে যায়। এমন অসহায় অবস্থার পেছনে অনুন্নত গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, অজ্ঞতার কারনে ওজা-বৈদ্যের কাছে ছোটাছুটি করে সময়ক্ষেপণ, উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এন্টি ভেনম না থাকা দায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে সাপের কামড়ে মৃত্যুর কারনগুলোতে এসব স্পষ্ট।
২০ মে ২০২৩ — বাহারছড়া ইউনিয়নের চাপাছড়ি এলাকায় ঘরের পাশে মুরগির ঘর বন্ধ করতে গিয়ে নাসরিন সোলতানা (৩৩) নামে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সাপের কামড়ে মারা যান। তিনি পশ্চিম চাপাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন।
১২ জুলাই ২০২৫ — বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আস্করিয়া নতুনপাড়ায় ঘরের ভেতর খেলতে গিয়ে দেড় বছর বয়সী হাদিকা সোলতানা নুসরাত নামের এক শিশু সাপের কামড়ে মারা যায়। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আরো বিস্তারিত পড়ুন নিচের বক্স থেকে।
১০ অক্টোবর ২০২৫ — বাহারছড়া ইউনিয়নের পশ্চিমকুল এলাকায় পুকুরঘাটে ওযু করতে গিয়ে মুনতাহা বিনতে হাবিব (৩৫) নামে এক বেসরকারি স্কুল শিক্ষিকার মৃত্যু হয়। তিনি বাহারছড়া আইডিয়াল প্রি ক্যাডেট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
শিশু হাদিকা নিয়ে আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য নেই। কিন্তু দুই শিক্ষিকার মৃত্যু অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই সময়ক্ষেপণ আর সিদ্বান্তহীনতাই তাঁদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। গতকাল (১০ অক্টোবর, ২০২৫) রাতে মৃত্যু বরণ করা শিক্ষিকা মুনতাহা সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ির পাশের ডোবায় পড়ে যাওয়া বাচ্চার খেলনার বল পায়ে নিতে গিয়ে তিনি সর্পদংশনের শিকার হন। হালকা ব্যাথা অনুভব হয়েছে বলে শুরুতে তিনি অতটা গুরত্ব দেয়নি। পারিবারিক সূত্রে জানা যায় তাঁকে প্রথমে পল্লী ডাক্তারের নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার পানি দিয়ে ঔষধ খাইয়ে দেন অথচ সাপে কাটা রোগির কোন কিছু খাওয়া অনুচিত, এরপরে বাঁশখালী আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্থাৎ সম্পূর্ণ সিদ্বান্তহীনতা আর আতংকে একের পর এক ভুল সিদ্বান্ত নেয়া হয়েছিল। সাথে সাথে রিজার্ভ সিনএনজি করে যদি তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া যেত তবে তিনি হয়তো বেঁচে যেতে পারত।
চাম্বল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম বিলেন,’ সাপের এন্টিভেনাম সরকারি বা বেসরকারিভাবে সহজে কোথায় পাওয়া যায় তার একটি তালিকা খোঁজ নিয়ে অনলাইনে প্রচার করলে অনেক প্রাণ বেঁচে যাবে।কোথায় যাবে ভাবতে ভাবতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল যায়গায় গিয়ে মৃত্যুকে তরান্বিত করে।এব্যাপারে আপনারা মানুষকে হেল্প করতে পারেন।জানি আইসিইউ না থাকায় উপজেলা হাসপাতালগুলোতে এন্টিভেনাম থাকেনা,কতটুকু তা সত্য তা বের করতে পারলে প্রথম থেকেই জেলা হাসপাতালে চলে যেতে পারত! গত কয়েক মাস আগেও প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক সাপের কামড়ে মারা গেলেন।
স্থানীয় যুবক বুরহান উদ্দীন বলেন,’ বিষাক্ত সাপের প্রকোপ গ্রামে অথচ তার ভেনম রাখা হয় শহরে। সাপে কাটার পর শহরে নিতে নিতে আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন। এই এক অদ্ভুত ব্যাপার! প্রতিবছর আমাদের উপজেলায় অনেক মানুষ সাপে কাটায় মৃত্যুবরণ করেন। সব হয়ত নিউজও হয় না। আমাদের রাজনীতিবিদ বা সামাজিক সংগঠনের উচিত উপজেলা হাসপাতালে ভেনম রাখার আন্দোলন গড়ে তুলা।”
☞ সাপে কাটলে কী করবেন?
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ যিনি সাপের দংশন এবং অ্যান্টিভেনম নিয়ে গবেষণা করেন, তিনি বলছিলেন, সাপ কাটলে কী করতে হবে, তার সঙ্গে কী করবেন না- দুইটাই জেনে রাখতে হবে।
১. দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন
২. হাত বা পা ভাঙলে যেমন করে শক্ত কিছু দিয়ে কাপড় দিয়ে হলকা করে বাধা হয়, সেভাবে বাধুন।
⚠️ কি করবেন না
১. আতংকিত হওয়া যাবে না।
২. ওঝা বা ঝাড়ফুঁকে, হাতুড়ে ডাক্তারে উপর নির্ভর করে কালক্ষেপণ করবেন না।
৩. চিকিৎসক দেখার আগ পর্যন্ত কিছু খাওয়া উচিত না।
৪. কোনো মলম বা মালিশ লাগানো উচিত না।
৫. সাপে কাটা জায়গায় শক্ত করে বাঁধা, কারণ রক্ত জমে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।
৩. সাপে কাটা পেশী যতটা কম সম্ভব নড়াচড়া করুন, পেশীর নড়াচড়া যত কম হবে, বিষ তত কম ছড়াবে।
লেখক : প্রধান নির্বাহী, বাঁশখালী এক্সপ্রেস