
হিন্দু বাঙালিরা যখন তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা পালন করেন, ঠিক তখনই ভারতের অসুর বংশীয় আদিবাসীরা পালন করেন শোক। তাদের লোককথা অনুযায়ী, আর্যদের দেবী দুর্গা এই সময়েই ছলনার মাধ্যমে তাদের রাজা মহিষাসুরকে হত্যা করেছিলেন। সেই ক্ষতির বেদনা তারা হাজার বছর পরেও ভোলেননি।

‘অসুর’ একটি বিশেষ আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যাদের নাম পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও বিহারের সরকারি তপশিলি উপজাতির তালিকার প্রথম স্থানে রয়েছে। প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় মহিষাসুর স্মরণে আয়োজন করা হয় “মহান অসুর সম্রাট হুদুড় দুর্গা স্মরণ সভা”। গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে এমন অনুষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০০–এর কিছু বেশি। ২০১৮ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০–র বেশি। আর এবছর শুধু মালদা, উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এই তিন জেলায়ই ৩৫০০–র বেশি স্থানে স্মরণসভা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাঝি পারগানা গাঁওতার সংগঠনের নেতা চরন বেসরা।

মহিষাসুর কেন হুদুড় দুর্গা :
হিন্দু পুরাণে দুর্গাকে মহিষাসুরবধিনী বলা হয়। অন্যদিকে আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন, তাদের সম্রাট মহিষাসুরই ছিলেন হুদুড় দুর্গা। গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপনের মতে, “হুদুড় মানে ঝড়, বজ্রধ্বনি বা তীব্র শক্তি। আর দুর্গা অর্থে এখানে বোঝানো হয়েছে দুর্গের রক্ষক। সুতরাং হুদুড় দুর্গা বলতে প্রবল শক্তিশালী এক রাজাকে বোঝানো হয়েছে।”
লোককথায় বলা হয়, মহিষাসুর ছিলেন প্রজাবৎসল ও বলশালী শাসক। তাকে প্রতারণার মাধ্যমে এক গৌরবর্ণা নারী হত্যা করেন। হিন্দুদের দেবী দুর্গার প্রতিমাতেও দেখা যায় সেই আর্য বৈশিষ্ট্য—গৌরবর্ণা, টিকলো নাক। অন্যদিকে মহিষাসুরের প্রতিমা সাধারণত গাঢ় বর্ণ, কোঁকড়ানো চুল ও মোটা ঠোঁটের, যা অনার্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত।

বিপরীত কাহিনী :
হিন্দু পুরাণে মহিষাসুরকে দানব ও দেবীর শত্রু হিসেবে দেখানো হলেও, আদিবাসী সমাজ তাকে বীর রাজা হিসেবে স্মরণ করে। তাদের মতে, নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী মহিষাসুর কখনোই কোনো নারীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতেন না। তাই আর্যরা দুর্গাকে ব্যবহার করেছিলেন তার বিরুদ্ধে।
এই বিশ্লেষণ নতুন নয়। উনবিংশ শতকে জ্যোতিরাও ফুলে এবং পরে ড. বি. আর. আম্বেদকর মহিষাসুরের কাহিনীকে আর্য–অনার্য সংঘাতের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। তারা যুক্তি দেন, দানব, রাক্ষস, দৈত্য বা অসুররা আসলে আদিবাসী মানুষই ছিলেন।
শোক পালনের ধরণ :
দুর্গাপূজার সময় অসুররা অরন্ধন পালন করেন, অনেক সময় জানলা–দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন, যাতে ঢাক–ঢোল বা মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ কানে না আসে। তারা অশৌচ পালন করেন এবং ‘ভুয়াং’ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ‘দাসাই’ নাচ করেন। এই নাচে পুরুষরা নারী যোদ্ধার সাজে শোকগাথা গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরেন।
তাদের গানগুলিতে প্রশ্ন থাকে, যেমন—“আমাদের রাজাকে কে নিয়ে গেল?” তারা বিশ্বাস করেন, হুদুড় দুর্গা শুনতে পেলে এর উত্তর দেবেন।
আধুনিক সময়ে মহিষাসুর স্মরণ :
২০১২ সাল থেকে সংগঠিতভাবে বড় আকারে মহিষাসুর স্মরণ শুরু হয়। ষষ্ঠী থেকেই শোক শুরু হয় এবং দশমীতে হয় প্রধান অনুষ্ঠান। তবে করোনা মহামারির কারণে এবছর কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান বাতিল হলেও গ্রামে গ্রামে মানুষ নিজস্বভাবে স্মরণ করেছেন।
মহিষাসুর গবেষক প্রমোদ রঞ্জনের মতে, আগের স্মরণ অনুষ্ঠান ছিল শুধুই লোকগাথা নির্ভর। এখন সেটি রূপ নিচ্ছে ইতিবাচক সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে—যেখানে একদিকে মনুবাদী সংস্কৃতির বিরোধিতা, অন্যদিকে আদিবাসী সংস্কৃতির পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।
মহিষাসুরের খোঁজে :
গবেষণা বলছে, মহিষাসুর–কেন্দ্রিক লোকগাথার ইতিহাস প্রায় ৩,০০০ বছরের পুরনো, এমনকি বৌদ্ধ যুগের আগেকার। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে তার কাহিনী প্রচলিত—ভারতের উত্তর প্রদেশ, মাইসোর, নেপাল ও এমনকি বাংলাদেশের নানা এলাকায়ও।
প্রমোদ রঞ্জন উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখন্ড ও খাজুরাহো মন্দিরে মহিষাসুরের প্রত্ননিদর্শন খুঁজে পান। তার মতে, মহিষাসুর হয়তো কোনো একক ব্যক্তি ছিলেন না, বরং এটি ছিল একটি উপাধি—যার ধারাবাহিকতা বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল এবং যা আজও আদিবাসী সমাজ বহন করে চলেছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : পারুল আকতার
ইমেইল : banshkhaliexpress@gmail.com
www.banshkhaliexpress.net | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত | © CW26020