নীল জামশেদ ▪️
অনেক দিন হলো পারকি  সৈকতে আটকে আছি। কলকাতা ছেড়ে পারকি সমুদ্র সৈকত আজ আমার শেষ ঠিকানা।  বুকের ডান পাশে বড় ইঞ্জিনটিতে দিন দিন মরিচা বেড়েই চলছে। হাহাকার বুকে মরিচার আর্তনাদের সাথে লুকিয়ে রাখা কষ্টগুলো যেন খসে খসে পড়ছে।

কষ্ট হয়।
খুব কষ্ট হয়।

এক সময় ভরা যৌবনে প্রশান্ত, আটলান্টিক, ভারত মহাসাগর চষে বেড়াতাম। আর আজ নিয়তির পরিহাসে যৌবনটা আনোয়ারার পারকি সৈকতে শেষ হতে বসেছে।

একটা সময় ছিল আমার শব্দ শুনে আটলান্টিকে কত নাবিক কতবার তাদের জাহাজ সরিয়ে আমাকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। আর আজকাল বাংলাদেশি ছোট ছোট জাহাজগুলো আমাকে হর্ণ বাজিয়ে বিচলিত করে।

লজ্জা হয়।
খুব লজ্জা হয়।

মনে পড়ে?

বর্ষার সেই দিনটির কথা। ২০১৭ সালের ৩০ মে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে নাবিক ধরে রাখতে না পারায় বাতাসের বেগ আমাকে  পারকি উপকূলে তুলে দিয়েছিল।
সে হতে আর আমি সাগরে নামতে পারিনি।

শুধু চোখের জল হিসেবে ইঞ্জিনে জমাট জল খসেছি।

এই কষ্টের মাঝে তবু অনুপ্রেরণা পাই। পারকি সৈকতে আসা প্রতিটা পর্যটক আমাকে একবারের জন্য হলেও দেখে যায়। সেই সাথে আমাকে নিয়ে কত সেলফি। আহ্ মনটা তখন জুড়ায় যায়।

মনে হয় আমিই পৃথিবীর একমাত্র জাহাজ, যেটিকে নিয়ে এত লোক ছবি তুলেছে। তরুণ তরুণীরা আমার গা ছুঁয়ে দেখে। কত প্রশংসা করে আমাকে নিয়ে।

এদিন দেখলাম ভিন্ন কান্ড। খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগেছি আশপাশের হট্টগোল শুনে।

প্রচুর লোকের ভীড়।
সকলেই নায়ক সাকিব খান, বুবলি বলে বলে ডাক ছাড়ছে। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে সাকিব খান ও বুবলি উপরে উঠে এসেছে।

একজনকে বলতে শুনলাম তারা ‘সুপার হিরো’ ছায়াছবির শুটিং করছে।

সাকিব খান ও আমার প্রশংসা করলো।

তরুণরা রোজ আমার গলায় পড়া শিকল বেঁয়ে উপরে উঠতে চায়। কিছুটা উঠার পর তারা দুলতে থাকে। তখন আমার বড্ড হাসি আসে। একবার একজন পড়ে হাত ও ভেঙ্গেছিল। তবু তারা আমাকে ভালবাসে।

আরও পড়ুন  নিখোঁজ স্বামীকে পাগলের মত খুঁজছেন রোকসানা

গত কয়েকদিন ধরে খুব চিন্তিত আছি আমি। ওইদিন বিকালে আমাকে দেখতে এসে জাহাজের কেবিনে একদল খুব সিরিয়াস আলাপে ব্যস্ত ছিল। কান পেতে শুনছিলাম তাদের কথা,

“তারা নাকি আমাকে আর সাগরে নামাতে পারবে না। খন্ড খন্ড করে নাকি আমাকে কেটে বিক্রি করে ফেলা হবে। তখন হতে টেনশন বেড়েই চলছে”

যে ভাবা সে কাজ। আজ আমার গায়ে প্রথম কোপটা লাগালো। ধরাশায়ী হয়ে যাচ্ছে সারা শরীর। আমাকে বাঁচতে না দিয়ে কেন তারা এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা ভাবলেই গা শিওরে উঠে।

ভেজা চোখে পারকি সৈকতে তাকিয়ে থাকি। অপরূপ সৌন্দর্যের বেলাভূমি।  একপাশে ঝাউয়ের সারি, অন্য পাশে ঢেউ আর ঢেউ ।

কত পর্যটক এসে যায়।

আমার আর যাওয়া হয় না।

এখানেই সব শেষ।

একদিন সবাইকে এভাবে বিদায় নিতে হবে।

বিদায় সবাইকে

লেখক, ইউটিউবার, ক্রীড়াবিদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *