শেরপুরের সীমান্ত জনপদে বন্য হাতি-মানুষে দ্বন্দ্ব কমছেই না। বরং সাম্প্রতিককালে এ দ্বন্দ্ব আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। পাহাড় থেকে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসা বন্য হাতির দল মানুষের বাধা পেয়ে ফসলের মাঠ ও বাড়িঘরে তাণ্ডব চালাচ্ছে। এমনকি পায়ে পিষ্ট করে, শুঁড়ে পেঁচিয়ে তুলে আছাড় দিয়ে মানুষের জীবনহানি ঘটাচ্ছে।

ধান পাকার মৌসুমে বেড়ে যায় হাতির তাণ্ডব। পাহাড়ে খাদ্যের অভাবে হাতির পাল নেমে আসে ধানক্ষেতে। এদিকে পাকা ধানক্ষেতসহ জান-মাল রক্ষায়  কৃষকরা মশাল, বল্লম ও পটকা নিয়ে পাহারা দেয়। এ সময় বেঁধে যায় হাতি-মানুষের যুদ্ধ।

চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। এতে হাতির হামলায় মারা যায় কৃষক। কখনো ধানক্ষেত রক্ষার বিদ্যুতের ফাঁদে পড়ে মারা যায় হাতি। হাতি-মানুষ যুদ্ধ দীর্ঘদিনের। গারো পাহাড়ে খাদ্যের সংকটে ক্রমেই বাড়ছে যুদ্ধের মাত্রা। 
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, হাতির আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে সরকার। শুক্রবার (৮ নভেম্বর) সরেজমিনে স্থানীয় বাসিন্দা, কৃষক ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন সূত্রে এ তথ্য পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেরপুরের শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ীর সীমান্তের প্রায় ৪০ কিলোমিটারজুড়ে গারো পাহাড়। ভারতের মেঘালয় রাজ্য পাহাড়ঘেঁষা মেঘাদল, দীঘিলানা, হারিয়াকোনা, বাবেলাকোনা, চান্দাপাড়া, মালাকোচা, হালুহাটি, বড়ইকুচি, বালিজুরি,  খ্রিস্টানপাড়া, খারামোরা, রাঙাজান, তাওয়াকোচা, দুদনই, গজনী, বাকাকোড়া, আদর্শগ্রাম, রাংটিয়া, গান্ধীকুড়া, হলদীগ্রাম, নকশী, নলকুড়া, কুশাইকুড়া, মধুটিলা, ঝোকাকুড়া, আন্ধারুপাড়া, খলচান্দা, বাতকুচি, বারোমারী, নৌকুচি,  নাকুগাঁও, পানিহাতা, বৈশাখীবাজার, গারোকোনা, সন্ধ্যাকুড়াসহ প্রায় অর্ধশত গ্রাম রয়েছে।

১৯৯৫ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ওইসব গ্রামে হাতির আক্রমণে  ৬০ জন মানুষের  মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক। অপরদিকে বিদ্যুতের ফাঁদসহ বিভিন্ন কারণে ৩০টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হাতি হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ হাতির মৃত্যু হয়েছে বৈদ্যুতিক ফাঁদে, নয়তো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামবাসীরা।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছরের ১৪ এপ্রিল ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বন্য হাতির হামলায় নিহত হয় শ্রীবরদীর ঝুলগাঁও গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে কৃষক আব্দুল করিম (৩০)।  আহত হয় কবির হোসেন (১৮)। হাতির তাড়া খেয়ে মো. আব্দুল হামিদ (৭০) নামে এক দর্শনার্থীর মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাতে ঝুলগাঁও গ্রামে তাবলিগ জামায়াতে এলে এ ঘটনা ঘটে। তিনি সদর উপজেলার বাকারকান্দা এলাকার বাসিন্দা। গত বছর ১ মে সন্ধ্যায় হাতিবর গ্রামের পাহাড়ে বন্য হাতির হামলায় কৃষক আব্দুল হামিদ (৫৫) নিহত হন। পার্শ্ববর্তী ঝিনাইগাতীর তাওয়াকোচা পাহাড়ে গরু চড়াতে গিয়ে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে নুর ইসলাম (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। ২৯ জানুয়ারি রাতে তাওয়াকোচার পাহাড় থেকে  তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত নুর ইসলাম গরু চরণ দুদনই গ্রামের মৃত শাহার উদ্দিন শেখের ছেলে। গত বছর ১৯ জানুয়ারি হাতির হামলায় আহত হন নওকুচি গ্রামের  মৃত আবুল হোসেনের ছেলে কৃষক আব্দুল্লাহ (৪০)। বন্য হাতির হামলায় কৃষক বিজয় সাংমা (৬০) নিহত হয়। গত ২৮ এপ্রিল রাতে সমশ্চূড়া পাহাড়ে এ ঘটনা ঘটে। নালিতাবাড়ীর কাটাবাড়িতে বন্য হাতির হামলায় কৃষক শরিফুল আলম (২৫) নিহত হন। গত ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কাটাবাড়ি পাহাড়ে এ ঘটনা ঘটে। নিহত শরিফ দাওধারা কাটাবাড়ি গ্রামের ইউপি সদস্য আব্দুল করিমের ছেলে।  গত ২৬ এপ্রিল বাতকুচি গ্রামের মৃত তমিজ উদ্দিনের ছেলে কৃষক আলহাজ মো, উমর আলী (৬০) নিহত হয়েছেন।  চলতি বছর গত ২ আগস্ট রাতে হাতির হামলায় কালাকুমা গ্রামের চাম্বু গংসহ  তার বাড়ির ছয়টি বসতঘর ভাঙচুর হয়েছে। 
গত ৫ অক্টোবর ঝিনাইগাতীর গজনী গ্রাম থেকে এক বন্য হাতির মৃতদেহ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ।  গত ১ অক্টোবর নালিতাবাড়ী বাতকুচির গ্রামের ধানক্ষেতে বৈদ্যুতিক ফাঁদে একটি হাতির মৃত্যু হয়। এ নিয়ে ১০ বছরে ৩০টি বন্য হাতির মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাতির আক্রমণে ৬০ জন মারা যান। হাতি হত্যার ঘটনায় ২ বছরে তিনটি মামলা হয়েছে। বন বিভাগের তথ্যে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।  
সাবেক এমপি মাহমুদুল হক বলেছেন, গারো পাহাড়ে হাতি তাড়াতে বিএনপির পক্ষ থেকে ভলান্টিয়ার টিম গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে টিমের সদস্যদের মাঝে সার্চলাইটসহ বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হয়েছে। তাদের আরো সহায়তা করা হবে।

আরও পড়ুন  ৪২তম বিসিএস যুদ্ধে ছনুয়ার রাশেদের সাফল্য

গত ৭ নভেম্বর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে হাতি সংরক্ষণ সমন্বয় কমিটির এক সভায় হাতি-মানুষে দ্বন্দ্ব নিরসনে ইআরটি (এলিফেন্ট রেসপন্স টিম) টিমকে শক্তিশালী করার তাগিদ দেওয়া হয়। সভায় জানানো হয়, সরকার এ পর্যন্ত বন্য হাতির আক্রমণে নিহত, আহত ও আবাদ-ফসল, ঘরবাড়ির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ৯৬ লাখ ৯২ হাজার ২০০ টাকা বিতরণ করেছে।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, হাতির আক্রমণে নিহতদের পারিবার ও ক্ষতিগ্রস্ত  কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত এক কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *