অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী
৭ই মার্চ একটি তারিখ নয়, মহাকালের ইতিহাসের একটি  অংশ। এইদিন লক্ষ লক্ষ কৃষক শ্রমিক তাঁতি জেলে মেহনতি মানুষসহ সর্বস্তরের জনতা যারা জমায়েত হয়েছিলেন, তাদেরকে কেউ টেণ্ডারের লোভ লাইসেন্স পারমিটের অনুমতি, এম পি মন্ত্রী হবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনেননি। তারা কেউ তারু মিয়ার ( টাকার বিনিময়ে  সব রাজনৈতিক দলের সমাবেশে যে ব্যক্তি লোক ভাড়া দেয়) গাঁজার টাকায় ভাড়া করা লোক নয়। এইদিনের জমায়েতের জন্য বাস ট্রাক ভাড়া করা হয়নি। শুধুই সেদিন সবাই সপ্রণোদিত হয়ে এসেছিলেন নেতার আহবানে, নেতার নির্দেশ শুনতে।
সভায় সভাপতি নেই, সঞ্চালক নেই, সম্বোধন নেই, আর কোনো বক্তাও নেই, শুধু তিনিই মূখ্য। সরাসরি বঙ্গবন্ধু জনতার মঞ্চে উঠে সমগ্র জাতিকে সম্বোধন করেন, ‘ভায়েরা আমার’। তাঁর মুখে শব্দটি বড় বেশী মানানসই কারণ জাতীয় নেতাদের ‘স্যার’ সম্বোধনের পরিবর্তে ভাই সম্বোধন করার  প্রচলন তিনিই  করেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে ১৮ সংখ্যাটি কাকতালীয় ভাবে জড়িয়ে গেছে। তিনি জীবনে ১৮ বার জেলে যান, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের কালোরাত্রিতে ঘাতকের  ১৮টি গুলি বুকে ধারণ করেন, জালিম শাসক তাঁর দাফন কাফন এবং জানাজার নামাজে ১৮ জন মানুষ অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়। ৭ই মার্চের ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদানের ১৮ দিন পর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং পাকিদের হাতে বন্দী হন।এই ১৮ মিনিটের ভাষণে পঞ্চাশ বছরের এক যুবক সমগ্র জাতিকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেন, তাঁর ‘তুমি’ শুনে সমগ্র জাতি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ৩০ লক্ষ মানুষ জীবন উৎসর্গ করলো, এমন নেতা দুনিয়ায় বুকে জন্মানো সহজ নয়।
তৃতীয় বিশ্বের এক উঁচু নেতা। উচ্চতায় কোনো সাধারণ বাঙালি নন, পাঁচ ফুট ১১ ইঞ্চি। বামুনের মাঝে মহাকায়। কন্ঠস্বর স্বাধীন, মৃত্যু তুচ্ছ, বীরের সাহসে বুক টান করে দরাজ গলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর হাজার হাজার কামাল বন্দুক ও গোলাবারুদের সামনে এই ভাষণ বিস্ফোরণ ঘটান তিনটা বিশ মিনিটের সময়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক  প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন সেরা কালজয়ী ভাষণটি দিয়ে ছিলেন বিপ্লবের পর শান্ত সুশৃঙ্খল পরিবেশে, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণী হিসেবে। বঙ্গবন্ধু ১ হাজার ১০৮ শব্দের কালজয়ী ভাষণটি দিয়ে ছিলেন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। লিংকনের ভাষণের মত দুনিয়ার প্রায় সেরা ভাষণগুলো ছিলো লিখিত। বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ ছিল অলিখিত।  এই ভাষণ প্রদানের পূর্বের দিন ৬ মার্চ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক বসে। বৈঠকে কেউ বলেন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করতে আর কেউ বলেন স্বাধীনতা ঘোষণা না করে আলোচনার পথ খোলা রাখতে। অন্য দিকে ছাত্রদের ছিলো স্বাধীনতা ঘোষণার জোর দাবী। বঙ্গবন্ধু কী করবেন তা ভাবতে থাকেন। চিন্তিত বঙ্গবন্ধুকে দেখে বেগম মুজিব বললেন, ‘আল্লাহ নাম নিয়ে তোমার মন দিল অন্তর থেকে যা আসে তা বলে দিবে’। ক্যান্টনমেন্টে তখন প্রস্তুতি চলছিল, যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় ব্যাপক বোমা হামলা করার। ভাষণ প্রদানের সময় চারদিকে আকাশে হেলিকপ্টার উড়ছিল, হামলা করার জন্য। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিলেন কিন্তু ভাষণে চারটি শর্ত জুড়ে দিলেন পাকিস্তানিদের নিকট। (১) মার্শাল প্রত্যাহার। (২) সেনাবাহিনী ব্যারেকে নিয়ে যাওয়া। (৩) নির্বাচিত প্রতিনিধির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর। (৪) কয়েক দিনের মধ্যে যে সব হত্যাকাণ্ড সংগঠিত  হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা। এই চারটি শর্ত জুড়ে দিয়ে  বুঝাতে চেয়েছেন তিনি পাকিস্তান ভাংতে চান না। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের  নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সেই ক্ষমতা তিনি গ্রহণ করতে চান। যদি ন্যায্য এই দাবী না মানে তবে পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব তাঁর নয়, পাকিস্তান শাসকের। আর এ সব শর্ত না মানলে  স্বাধীনতার ঘোষণা স্পষ্ট উচ্চারণ করে বলেন,’আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো। ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে জানিয়ে দিলেন, আমি যদি হুকুম দিতে না পারি, বেঁচে যদি না থাকি, যদি কারাগারে থাকি, তখন তোমাদের সামনে থাকবে এই ভাষণ। এই ভাষণে যা উল্লেখ করেছি তা তোমরা পালন করবে। এ সব কথার সরল অর্থ হলো, আমি হুকুম দিতে না পারলে এটিই আমার হুকুম।
তৎকালীন একাধিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ দিতে গিয়ে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেন। তিনি সবই বললেন, কিছু বাকি রাখেননি। কিন্তু শত্রুর ফাঁদে পা দেননি। বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হতে চাননি। উল্টো শত্রুকে ফাঁদে ফেলেছেন। যার প্রমাণ পরের দিনের আই এস আই-‘র রিপোর্ট। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সাথে বক্তব্য রেখে চলে গেল। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা করলো, অারেক দিকে ৪টি শর্ত জুড়ে দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হতে রক্ষা পেয়ে গেল। পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করলো না। আমাদের নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না। আমরা যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো’।
বঙ্গবন্ধু যদি এই ভাষণে বলতেন, বাংলাদেশ আজ হতে স্বাধীন বা যে যেখানে আছো সবাই মিলে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করো। তাহলে ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যার দায়িত্ব তাঁকে নিতে হতো। তিনি চরম ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলেন, হত্যাকাণ্ড যেন পাকিরা শুরু করে। তখন বাঙালি জনগণ আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করলে দুনিয়াবাসীর সমর্থন মিলবে  এবং কেউ বঙ্গবন্ধুকে দোষারোপ করতে পারবে না।
ইসলামের যুদ্ধনীতির দিকে তাকালে দেখতে পাই, মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে ৮৩টি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, ২৭ টি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ সব যুদ্ধ আক্রমাণত্মক ও প্রতিশোধমূলক ছিলো না, ছিলো আত্মরক্ষামূলক। যতক্ষণ কাফিরগণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা  আক্রমণ শুরু করেনি ততক্ষণ মুসলমানগণ যুদ্ধ শুরু করেননি। আক্রান্ত হওয়ার পর আত্মরক্ষার্থে মুসলমানগণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন। বঙ্গবন্ধু মূলত মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুদ্ধনীতিই অনুসরণ করে ছিলেন।
কেউ কেউ বলেছেন, সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ ঘোষণা করতেন তাহলে লাখো জনতা ঢাকা সেনানিবাস আক্রমণ করত, হয়তো কম মূল্যে স্বাধীনতা অর্জিত হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মানব হত্যার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে চাননি, তাঁর সিদ্ধান্ত ছিলো যতক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্ত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আক্রমণ করবে না। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার বুকে  যখন ‘অপারেশন সার্চলাইট’-‘র নামে ঘুমন্ত মানুষের উপর একতরফা আক্রমণ করে তখন ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সমস্ত যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির দায়িত্ব পাকিদের উপর তুলে দেন। (চলমান)

আরও পড়ুন  বৈলছড়িতে পাহাড় কাটার মহোৎসব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *