ডক্টর আবদুল করিম (ইতিহাসবিদ)
বাঁশখালী চট্টগ্রাম জিলার পটিয়া মহকুমার একটি থানা। এই থানার উত্তরে সাঙ্গু নদী (বা শঙ্খ নদী) ও আনোয়ারা থানা, পূর্বে-পাহাড় শ্রেণী, ও সাতকানিয়া থানা, পশ্চিমে সমুদ্র (বঙ্গোপসাগর) এবং দক্ষিণে কক্সবাজার জিলার চকরিয়া থানা। ফলে বাঁশখালী তিন দিকে প্রাকৃতিক সীমারেখায় বেষ্টিত এবং ইহার আয়তন অন্যূন ১৫০ বর্গ মাইল।
বাঁশখালীর বুক চিড়ে একটি খাল উত্তর দক্ষিণে প্রবাহিত, ইহা উত্তরে সাঙ্গু নদীর সঙ্গে এবং দক্ষিণে সাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই খালটি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত, উত্তরে কুমিরা ছড়া, আরও দক্ষিণে ফাঁড়ি খাল, আরও দক্ষিণে গর্দভীর খাল, আরও দক্ষিণে জুলকদর খাল এবং সমুদ্রের মিলনস্থলে খাটখালী। গণ্ডামারা গ্রামের পাশে এই খাল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রধান ধারাটি খাটখালীর দিকে এবং অন্য ধারাটি পূর্ব দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে চকরিয়া থানার বারবাকিয়ার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। পূর্বের পাহাড় শ্রেণী থেকে নির্গত হওয়া অনেক ছড়া পশ্চিম দিকে প্রবাতি হয়ে এই খালের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, মেযন কুমিরা ছড়া, কোদালা, সোনাইছড়ি, বরইতলী, জালিয়া খালী, চাম্বল খাল, নাপোরা খাল, পুঁইছড়ি খাল এবং ছোট বড় আরও অনেক। এই খাল থেকে পশ্চিম দিকেও কিছু খাল প্রবাহিত হয়েছে, কিন্তু এইগুলি ছোট এবং কোনটিই সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হয় নি। সমুদ্র, নদী, পাহাড় এবং খাল বা ছড়াগুলি বাঁশখালীর জন-জীবন নিয়ন্ত্রণ করে; আর্থিক এবং সামাজিক জীবন যাত্রায় এইগুলির অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশের ইতিহাস এখনও রাজা ও রাজদরবারের ইতিহাস, জনগণের ইতিহাস লিখার প্রয়াস এখনও সীমিত। জনগণের ইতিহাস না থাকার কারণ জনগণ ইতিহাস-বিস্মৃত; মুসলমানেরা ঐতিহাসিকভাবে ইতিহাস সচেতন জাতি হিসাবে
পরিচিত, কিন্তু আমরা এখন সেই অতীত গৌরব হারিয়ে ফেলেছি। বর্তমানে আমরা জন্মমৃত্যু দিবসও মনে রাখি না। হিন্দুরা জন্মমৃত্যু দিবস লিপিবদ্ধ করে রাখে, জন্মের পরে ছেলেমেয়ের কুষ্টি তৈরি করায়, কিন্তু দেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কম হওয়ায় মোটামুটিভাবে ঐতিহাসিক তথ্য সংরক্ষণ করার প্রবণতা দেখা যায় না। বর্তমানে অবস্থা এই যে, রাজাদের ইতিহাসের উপকরণও বিশেষ পাওয়া যায় না, জনগণের ইতিহাসের উপকরণ পাওয়া যাবে কাথায়? তাছড়া দেশের ইতিহাস যেখানে বিশেষ পাওয়া যায় না, সেখানে একটি থানার ইতিহাস পাওয়ার আশা করা যায় না।
বাঁশখালীর ইতিহাস চট্টগ্রামর ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কিন্তু চট্টগ্রামের খণ্ড খণ্ড ইতিহাস অনেক লিখিত হলেও ধারাবাহিক এবং পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনও রচিত হয় নি।
চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য এবং বিচ্ছিন্ন তথ্যাদি পাওয়া যায়। মধ্যযুগে চট্টগ্রাম পর্যায়ক্রমে বাংলার মুসলিম সুলতান, ত্রিপুরা এবং আরাকানের রাজাদের অধীনে ছিল। চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব নিয়ে এই তিন শক্তির মধ্যে ত্রিদলীয় যুদ্ধ অনেক দিন ধরে চলে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম প্রায়ই আরাকানের অধীনে থাকলেও মাঝে মধ্যে ত্রিপুরার রাজা বা বাংলার সুলতানেরা সারা চট্টগ্রাম (নাফ নদী পর্যন্ত) দখল করার প্রমাণ পাওয়া যায়। দুইজন বাংলার সুলতান কর্তৃক আরাকানের রাজধানী অধিকার করার কথাও বলা হয়ে থাকে। বাঁশখালীর ইতিহাস প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে সারা চট্টগ্রাম বা দক্ষিণ চট্টগ্রামের ইতিহাস লিখা প্রাসঙ্গিক নয়, বাঁশখালীর সঙ্গে সম্পৃক্ত যে সকল তথ্য পাওয়া যায়, তাই এখানে লিখিত হলো।
বাঁশখালী নামের বুৎপত্তি সম্পর্কে প্রামাণ্য কোন তথ্য পাওয়া যায় না, এই নামের উৎপত্তি কবে হয়, তাও জানার মত কোন তথ্য নাই। সাধারণতঃ যেই গ্রামে থানা কেন্দ্র অবস্থিত, সেই গ্রামের নামানুসারে থানার নামকরণ করা হয়, কিন্তু বাঁশখালীর ব্যাপারে ইহার ব্যতিক্রম। বাঁশখালী নামে কোন গ্রাম নাই; পূর্বে বাঁশখালী থানা অবস্থিত ছিল কুমিরা ছড়া খালের পূর্বতীরে রাতারকুল নামে একটি গ্রামে, পরে থানা প্রশাসনিক অফিস জলদী গ্রামে স্থানান্তরিত হয়। এখনও থানা হেড কোয়ার্টার জলদী গ্রামেই অবস্থিত। রাতা বা রেতা খাল বা নদীর ভরাট স্থানকে বুঝায়, সুতরাং রাতারকুল স্থানটি সাঙ্গু নদীর রেতার কুলে, অর্থাৎ সাঙ্গু নদী থেকে যেখানে খাল নির্গত হয়েছে, সেই স্থানটির নাম। এই স্থানটি বাঁশখালী থানার সর্বোত্তরে অবস্থিত, কিন্তু বর্তমান জলদী গ্রামটি বাঁশখালীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সুতরাং জলদীতে থানা স্থানান্তরের প্রধান কারণ বোধ হয় থানাকে কেন্দ্র স্থলে স্থাপন করা। বাঁশখালী নামে একটি ছোট গ্রাম আছে, কিন্তু এখানে কোন সময় থানা স্থাপিত ছিল না।
চট্টগ্রাম তথা বাংলা তথা পূর্ব ভারতের যেই প্রাচীনতম মানচিত্রটি আমাদের হাতে এসেছে, পার্তুগীজ ঐতিহাসিক জোয়াও দ্য ব্যরসের সেই মানচিত্রটি আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে অঙ্কিত। এই মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে আরাকানের সীমান্ত পর্যন্ত সমগ্র ভূভাগকে এস্টাডো কোদাবাসকাম বলা হয়েছে। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা মনে করে যে এস্টাডো কোদাবাসকাম দ্বারা খোদা বখশ খানের এস্টেট বা রাজ্য বুঝানো হয়েছে। এই খোদা বখশ খান ছিলেন বাংলার সৈয়দ সুলতান গিয়াস-উদ-দীন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-৩৮ খ্রিঃ) কর্তৃক নিযুক্ত দক্ষিণ (বর্তমান কক্সবাজার জিলা সহ) তখন বাংলার সুলতান গিয়াদ-উদ-দীন মাহমুদ শাহের অধীনে ছিল। কিন্তু দ্য ব্যরসের মানচিত্রে সারা দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাত্র দুই তিনটিচ স্থানের নাম পাওয়া যায়, যার মধ্যে চকরিয়া নামটি প্রধান। পটিয়া, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, বাঁশখালী কোন স্থানের নাম এই মানচিত্রে নাই। উপকূলে একটি দ্বীপের নামও চকরিয়া, আরও দুই তিনটি স্থানের নাম আছে, যেমন মসু এবং শোর, কিন্তু এইগুলি চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। দ্য ব্যরসের মানচিত্রে পটিয়া, সাতকানিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালী নামগুলির অনুপস্থিতি দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।