আলমগীর মোহাম্মদ ◾
ভুবন মোহন ধর আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। স্যার এখন অসুস্থ। কোকদন্ডী গুনাগরী উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক তাঁকে দেখতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ছবি শেয়ার করেছেন আজ। ছবিটা দেখে একেবারে মন ভেঙে গেল। স্যার অসুস্থ। শরীর পড়ে গেছে । ছয় ফিট দীর্ঘ সুদর্শন ভুবন স্যারের শারিরীক পরিস্থিতি এত নাজুক হবে ভাবা যায় না। স্যার জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন স্যার । আমাদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্যারের প্রয়াত বাবা বনমালী ধরের অবদান রয়েছে।নামে আর কাজে ভূবন ছিলেন আমার স্যার। ইংরেজি পড়াতেন। আমি স্যারের নজরে পড়েছিলাম ক্লাস সিক্সের প্রথম সাময়িক পরীক্ষায়। স্যারের কোর্সে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। বিদ্যালয়ের পিয়ন শিবু দা’কে বলে ঢেকে পাঠিয়েছিলেন অফিসে। ভয়ে অনেকটা কাঁপতে কাঁপতে স্যারের কক্ষে হাজির হয়েছিলাম। স্যার প্রশংসা করেছিলেন। একজন শিক্ষার্থীর ভালো ফলাফলে খুশি হওয়া ও তাঁকে ডেকে অনুপ্রাণিত করার শিক্ষা পেয়েছিলাম স্যারের সেইদিনের আচরণে। অত্যন্ত বড় মাপের মানুষ আমাদের স্যার। স্যার অনেকদিন বলতেন একটা কথা, ‘ইউ গট সেভেন্টি ওয়ান!’ সেই ক্লাস সিক্স থেকে স্যারের ইংরেজি ক্লাসের ভক্ত হয়ে পড়ি আমরা। শুদ্ধ উচ্চারণে, সাবলীলভাবে ক্লাস দিতেন তিনি । মোটিভেট করতেন ভালো ছাত্রদেরকে। স্যারের ইংরেজি ক্লাস আমাদের বেশ উজ্জীবিত করতো।
আমাদের সময়ে বিদ্যালয়ে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতে হতো আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদেরকে। পিতা মাতার পেশাগত পরিচয় দিয়ে শিক্ষকরা অনেক সময় মূল্যায়ন করতেন শিক্ষার্থীদের। এরকম একটা পরিবেশে ভুবন স্যার ছিলেন অন্য ভূবনের মানুষ। সবার প্রতি সমান বিবেচনাবোধ ছিলো স্যারের। স্যার হাত বাড়িয়ে না দিলে আমার পড়ালেখা এগোত না। ক্রীড়ামোদী ছিলেন স্যার। ক্রিকেট নিয়ে আলাপ করতেন মাঝেমধ্যে আমার সাথে। স্যারের কাছ থেকে প্রথম জেনেছিলেন ইংরেজি ভাষা শেখানোর নতুন কলাকৌশল সম্পর্কে। যেমন স্যার বিশ্বাস করতেন ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শুনে ভালো ইংরেজি শেখা যায়। কবিতা বুঝতে হলে চেম্বার্স টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ডিকশিনারি ব্যবহার করলে ভালো। গ্রামার পড়ার জন্য ইংরেজি গ্রামার টেক্সট পড়লে উপকার পাওয়া যায়। প্রচলিত গ্রামার বইগুলোকে তুলোধুনো করতেন স্যার।
ভুবন স্যার আমাকে বুঝতেন। একবার দেখা করেছিলাম স্যারের বাগান বাড়িতে। স্যার বৃক্ষ প্রেমিক ছিলেন। বিদ্যালয়ের আশেপাশে বাগান করার চেষ্টা করেছিলেন অনেকবার। এলাকার মানুষের কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি তখন। বাগান বাড়িতে বসে স্যার খাতা দেখছিলেন। খাতা দেখার এক ফাঁকে পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘ তুমি ভালো করবে জীবনে। ‘ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একবার দেখা হয়েছিল চকবাজারে। স্যার বলেছিলেন, ‘ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্ট কর্তে হলে বুদ্ধিমান হতে হয়। আমার ধারণা তুমি বুদ্ধিমান। ‘ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একাডেমিক ফলাফলে স্যারের সেই ভবিষ্যৎবাণী বাস্তবে সম্ভব হয়েছিল।
ভুবন মোহন ধর উদারনৈতিক মানুষ ছিলেন। নানা সময় বইপত্র কিনে দিতেন আমাকে। এসএসসির পর স্কুলে মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল আমাদের সময়। আমি মিষ্টির সাথে আম নিয়ে গিয়েছিলাম কারণ স্যার আম খেতেন খুব। সহকর্মীদের সাথে উঁচু গলায় কথা বলতেন না। দক্ষ প্রশাসক হয়তো স্যার ছিলেন না। তবে আমাদের স্কুলের পরিবর্তনে ভুবন স্যারের অবদান অনস্বীকার্য।
চাকুরিতে জয়েন করে ফোন করেছিলাম। তিনি বেশখুশি হয়েছিলেন। ডেইলি সানে একবার আমার শিক্ষকদের নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখেছিলাম। স্যার পড়ে ফোন করেছিলেন। অসুস্থতার খবর পেয়ে স্যারের বাসায় করলাম।স্যারের স্ত্রী জানালেন তিন মাস ধরে স্যার অসুস্থ স্যার । স্ট্রোক করেছিলেন । এখন বাড়িতে আছেন। অল্প সময়ের জন্য স্যার কথা বলতে পেরেছেন।
স্যারের সুস্থতার জন্য সবাই দোয়া করবেন। চোখের সামনে আমার জীবনের প্রথম নায়কের বুড়ো হতে দেখা এবং অসুস্থ হয়ে অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যাতনার। স্যারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অসীম।
লেখক,
শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ,
বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা।