দেশের বেসরকারীখাতে বৃহত্তর পাওয়ার প্রজেক্ট গন্ডামারা এসএস পাওয়ার প্লান্ট। এই পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে জায়গা দিতে গিয়ে ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক ছাড়তে হয়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটি। নামে মাত্র মূল্যে, (যদিও এই জায়গা ব্রোকারি করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে অনেকে) কেউ কেউ উন্নতির ছোঁয়া আসবে বলে নিজ থেকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল পাওয়ার প্লান্টের জন্য। আশা ছিল এলাকার ছেলে সন্তানদের কর্মসংস্থান হবে। সেই আশায় গুড়েবালি। প্রজেক্টের কাজের চাপ সামাল দিতে গিয়ে গন্ডামারা এখন এক বিধ্বস্ত জনপদের নাম। যারা হাসিমুখে একদিন মেনে নিয়েছিল আজ তারা ফুঁসছে ক্ষোভে, বঞ্চনায়।
অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাটের যে বেহাল দশা সে অবস্থা দেখে ষাটোর্ধ্ব সাহেব মিঞা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেন,’ অবাজি আরাত্তুন বউ ঝি অসপিটালত নেয়া ন’পরে, হষ্ট গরি গারিত তুলিয়েরে হদ্দুর নিলেই হাম অই যায়! (আমাদের প্রসূতি বউ, মেয়েকে হাসপাতালে নিতে হয়না, কষ্ট করে এই লক্কড়-মার্কা গাড়িতে আর রাস্তায় তুলে দিলেই হয়ে যায়) এভাবেই ক্ষোভ ঝাড়ছেন এলাকার লোকজন।
শুক্রবার সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণের খন্ডচিত্র দেখা গেল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে। বিকেল ৪টায় ৯ নম্বর গন্ডামারা ইউনিয়নের ব্যানারে “ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতা”র উদ্যোগে এক বিশাল মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সর্বস্তরের জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। মানববন্ধনে বক্তারা ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন, এবং স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
গন্ডামারা ইউনিয়নের ছাত্র-জনতার মুখপাত্র আমিনুর রশিদের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে উপস্থিত ছিল ইউনিয়নের সর্বস্তরের ছাত্র জনতা। বক্তারা একমত হয়ে বলেন, এসএস পাওয়ারের কার্যক্রমের ফলে স্থানীয় মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। পরিবেশ দূষণ, কর্মসংস্থান সংকট, সড়ক অবকাঠামোর ক্ষতি এবং জলাবদ্ধতা তাদের নিত্যদিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানবন্ধন থেকে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয় ;
১. স্থানীয়দের কর্মসংস্থান: এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং এর সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোতে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্ল্যান্টের কার্যক্রমের কারণে অনেকে তাদের স্থায়ী কর্মসংস্থান হারিয়েছেন।
২. ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক পুনর্নির্মাণ: প্ল্যান্ট নির্মাণকালে অতিভারী যানবাহনের কারণে গন্ডামারা-বড়ঘোনা সড়কসহ ইউনিয়নের প্রধান রাস্তাগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এসব সড়কের সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. জলাবদ্ধতা নিরসন: প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য জমি ভরাট এবং অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। অবিলম্বে ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলে সমস্যা সমাধান করতে হবে।
৪. পরিবেশ সংরক্ষণ: থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের কারণে কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশবিদদের সমন্বয়ে একটি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
৫. নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানি: প্ল্যান্টের ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে এলাকাজুড়ে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ওয়াসা স্থাপন বা গভীর নলকূপে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে।
৬. জাহাজ নোঙর বন্ধ: কয়লা এবং অন্যান্য মালামালবাহী জাহাজের এলোমেলো নোঙরকরণের কারণে স্থানীয় মৎস্যজীবীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অবিলম্বে এই কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি
মানববন্ধনে বক্তারা স্পষ্টভাবে জানান, এসব দাবি পূরণে বিলম্ব হলে বৃহত্তর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তারা আরও বলেন, “আমরা এসএস পাওয়ার কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের কাছ থেকে শুধু প্রতিশ্রুতি চাই না, বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই।”
প্রেক্ষাপট :
এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই গন্ডামারা ইউনিয়নে পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব পড়ছে। প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষের অসতর্ক পদক্ষেপের ফলে এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় মৎস্যজীবীরা তাদের জীবিকা নির্বাহে সমস্যায় পড়েছেন, জলাবদ্ধতা ও রাস্তার ক্ষতি স্থানীয়দের চলাচল ব্যাহত করছে। স্থানীয়দের প্রত্যাশা মানববন্ধনে উপস্থিত জনতার প্রত্যাশা, তাদের দাবি দ্রুত বাস্তবায়িত হবে এবং তাদের সমস্যাগুলো সমাধান হবে। বক্তারা বলেন, “এই আন্দোলন কেবল আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য, আমরা কারও বিরুদ্ধে নই। আমরা চাই সবাই সম্মিলিতভাবে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসুক।” এখন দেখার বিষয়, এসএস পাওয়ার কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসন এই দাবিগুলোর প্রতি কীভাবে সাড়া দেয়।