মুহাম্মদ নুর ▪️
সুশিক্ষা একটি জাতির উন্নতির সোপন ও মেরুদণ্ড।মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন একজন মানুষ সঠিকভাবে দাড়াঁতে পারে না,ঠিক তেমনি সুশিক্ষা ছাড়া একটি জাতি স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাড়াঁতে পারে না। একটি জাতির ভবিষ্যৎ উন্নতি,অগ্রগতি, সমৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভর করে, সেই জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার উপর।শিক্ষাবিদগণ মনে করেন’ ;জাতীয় উন্নতির গুরুত্বপূর্ণ সুচক হল দক্ষ মানবসম্পদ। আর দক্ষ মানবসম্পদ বির্নিমান তখনই সম্ভব যখন জাতিগোষ্ঠীকে জ্ঞান,বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি উন্নত নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত করা যাবে।কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় :স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে ও আমরা জাতীয় আকাংঙ্খার সাথে সংগতিপূর্ণ রেখে কার্যকর ও টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা উপহার দিতে পারি নাই।এই দায়ভার দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ কোনভাবে এড়াতে পারে না।বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য দেশ হিসেবে শিশু অধিকার সনদে অনুসমর্থন করেন।বিধায় শিশু অধিকার সনদের বিধানবলী বাস্তবায়নের লক্ষ্য বিদ্যমান শিশু আইন রহিতপূর্বক বর্তমান শিশু আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেন।জাতিসংঘ শিশু সনদের মুল লক্ষ্য হল আগামির নিরাপদ বিশ্বগড়ে তুলবার জন্য শিশুদের সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশে গড়ে তোলা।তার ধারাবাহিকতায় শিশু সুরক্ষা ও বৈশিক নাগরিক সৃষ্টির লক্ষ্য বাংলাদেশ সরকার বর্তমান শিশু আইন প্রণয়ন করেন।এটা সবার নিকট সুবিদিত, আজকের শিশুরা আগামি দিনের জাতির কর্ণধার। আগামিতে দক্ষ টেকসই মানবসম্পদ তৈরি করতে শিশুদের সুরক্ষিত রাখার কোন বিকল্প নেই। তাই সংশ্লিষ্ট গন মনে করেন শিশুর অধিকার, মর্যাদা,শিশুকে দৈহিক ও মানসিকভাবে সুরক্ষিত করতে এই আইন অতীব প্রয়োজন ।কেননা আমাদের দেশে প্রত্যন্ত এলাকায় বহুকাল ধরে কতিপয় প্রতিষ্ঠানে কিছু শিক্ষক কোমলতি শিশুদের শিক্ষা দিতে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতনের চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতন মহলের দৃষ্টিগোচর হয়। যা অত্যন্ত অমানবিক ও নিন্দনীয় এবং শিশু অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ইতিপূর্বে শিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা তার তত্বাবধানে থাকা শিশুদের শিক্ষা দিতে গিয়ে অমানবিক ও নিষ্ঠুরতমভাবে নির্যাতন করলে তার জন্য প্রচলিত আইনে কোন প্রতিকার ছিল না।এমনকি দায়ী শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের রেওয়াজ ও চর্চা ছিল না।যার দরুন বহু শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রদের নির্যাতনের ঘটনার বিচার হয় নাই। উপরন্তু সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে জনসমক্ষে আলোচনার কেদ্রবিন্দুতে আসে নাই। ফলে শিক্ষার নামে কুশিক্ষা ও নির্যাতন অনেকক্ষেত্রে শিক্ষা হিসেবে চলে আসছে।অনেক সময়, আইন আদালতে এটি প্রমাণিত হয়েছে, কিছু শিক্ষক ছাত্রকে তার মতো ব্যবহার করতে না পারায় শিক্ষা দেওয়াকে একমাত্র অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে নির্যাতন করছে।কিন্তু এর বেশির ভাগ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টিগোচর হতো না।অভিভাবকগন ভয়, সংশয়, আশংকা থেকে কার্যত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতো না।তার উপর আইনগতভাবে তেমন কোন সুযোগ ছিল না।ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতো।এর অন্যতম কারণ ছিল কিছু অভিভাবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে চাইতো না।অভিযোগ দিলে আবার কিছু অভিভাবক ছাত্রদের উল্টো শাসন করতো।কারণ ধর্মের দোহাই দিয়ে অনেকে বলতো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে সন্তান মানুষ হতে পারবে না।অথচ শিক্ষককে ও ইসলাম ও ধর্ম অন্যায়ের সুযোগ দেয় নাই। মাঝেমধ্যে শিশুরা দুবার শাস্তি পেতো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে।কিন্তু বর্তমান শিশু আইন ২০১৩(সংশোধিত ২০১৮)এর ৭০ ধারার বিধানমতে শিশুকে সবক্ষেত্রেই সর্বাবস্থায় নিষ্ঠুর আচরণ ও নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। যেখানে শিশুকে আঘাত,অবহেলা, বর্জন,অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ,ব্যক্তিগত পরিচর্যার কাজে ব্যবহার এবং অশালীনভাবে প্রদশর্ন যার দরুন শিশুর শারীরিক মানসিক ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে তা আইনের ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন কথা হল কোন শিক্ষাগুরু ছাত্রকে সুশিক্ষা ও সদাচরণ শিক্ষা দেওয়ার জন্য যদি মৃদু শাস্তি দেয় ইহা শিশু আইনের এই ধারার আওতায় আসবে কিনা।সোজা উত্তর হল ;না।কেননা একই আইনের ৯৮ ধারায় বলা আছে ;সরল বিশ্বাসে সংশোধনের নিমিত্তে অভিভাবক বা শিক্ষক যদি শিশু বা ছাত্রকে লঘু শাস্তি দেয়। তার কারণে কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যধারা রুজু করতে পারবে না।তাহলে বুঝা গেল শাস্তির মাত্রা এবং উদ্দেশ্যে একজন শিক্ষককে সুরক্ষা দিয়েছে। বর্তমান কার্যকর শিশু আইন ক্ষেত্র বিশেষে সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দদের সুরক্ষা দেয়। তবে তা কোনভাবেই অতিরিক্ত হতে পারবে না।শিশুরা আইনত কোন অভিযোগ দায়ের করতে পারে না। শিশুদের পক্ষে অভিভাবকগন এমন অভিযোগ দায়ের করেন।শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে আর্দশবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে অভিভাবকের ভুমিকা কোন অংশে শিক্ষকের চেয়ে কম নয়।অভিভাবকগণ যদি অভিযোগের ধরন বুঝতে পারেন এবং শিক্ষকদেরকে শিশুদের নিকট ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর রুপে তুলে ধরতে পারেন।তাহলে গুরুতর না হলে অভিযোগ দায়ের না করে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারেন।কারণ একজন ভালো শিক্ষক সবসময় ছাত্রের কল্যান কামনা করেন।আর কল্যাণের পথে পরিচালনা করতে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কোন শিক্ষক যদি মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে মাত্রাতিরিক্ত শাস্তি দেয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অবগত করে বিষয়টি মধ্যস্থতার মাধ্যমে সুরাহা করা গেলে দায়ী শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি অভিভাবক ও শিশুর জন্য কল্যাণকর হয়।একইসাথে পাঠ্যক্রমে শিক্ষকের মান মর্যাদা, শান শওকত নিয়ে কবিতা, কাব্য, প্রবন্ধ, রচনা অন্তর্ভুক্ত করা অতীব প্রয়োজন যেনো শিশু শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কদর বুঝতে পারে।অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে,একজন শিক্ষক তিনি ও মানুষ। উনার ও ভুল হতে পারে।তাই বলে সম্মানিত শিক্ষককে বিচারের মুখামুখি করা অনুচিত।এটা মনে রাখা প্রয়োজন, একজন নিরপরাধ শিক্ষক যদি ভুলে অন্যায়ের শিকার হন তাহলে আপনার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনষ্ট হতে পারে।সুতরাং শিক্ষক, অভিভাবক, প্রতিষ্ঠান প্রধানগন,যদি নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেন তাহলে বিদ্যমান শিশু আইন শিক্ষা ব্যবস্থার পথে অন্তরায় নয় বরং ক্ষেত্রে বিশেষে সহায়ক হবে।কেননা অন্যায়কারীর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা সভ্য শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য খুবই প্রয়োজন। শিক্ষার নামে বহুকাল ধরে চলে আসা শিশুর প্রতি অমানবিক আচরণ বন্ধ হওয়া চাই।
লেখক : অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট