Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আমার শিক্ষাগুরুঃ নাদেরুজ্জামান চৌধুরী

মোহাম্মদ জাকের হোছাইন ◾
তখন ১৯৮৩ সাল। ভর্তি হতে গেলাম বাণীগ্রাম হাই স্কুলে। নবম শ্রেণিতে। বিজ্ঞান বিভাগে। সাথে ছিল বড় ভাই। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি রুমে। ওখানে বসে আছেন দীর্ঘকায় গুরুগম্ভীর এক জ্যােতির্ময় ব্যক্তি। জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার নাম কী? কোন স্কুল থেকে এসেছ? কোন ক্লাসে ভর্তি হবে? কোন বিভাগ নেবে? কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলাম। এবার তিনি কলিংবেল টিপলেন। পিয়ন এসে আমাকে নিয়ে গেল অফিস রুমে। ভর্তি হলাম। তখন নবম শ্রেণিতে বাংলা ক্লাস চলছিল। ক্লাস নিচ্ছিলেন মালেক স্যার। আমিও ক্লাসে এট্ন্ডে করলাম। ক্লাস শেষে ফিরে গেলাম চকরিয়ায়। একদিন পর চলে এলাম নতুন স্কুলে। নতুন পরিবেশ, নতুন শিক্ষক, নতুন ব্ন্ধু। অন্যরকম অনুভূতি। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। দিনদিন ভালোবাসতে লাগলাম   নতুন বিদ্যাপীঠকে। পাহাড়ের টিলায় অনিন্দ্য সুন্দর স্কুলখানি। শিক্ষক শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাস। আমি শিহরিত, আমি বিমুগ্ধ-বিমোহিত। সব শিক্ষকদের আমার ভালো লাগে। আমি সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি তাঁদের। আমি ওনাদের স্নেহ পাই, ভালোবাসা পাই। কিন্তু একটি ব্যক্তিত্বকে আমার বরাবরই আলাদা মনে হতো। সবার মাঝে থেকে ও তিনি স্বতন্ত্র। তাঁর চালচলন, কথাবার্তা, পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুতেই রুচি ও ব্যক্তিত্বের ছাপ। নান্দনিকতার ছোঁয়া। তিনি নাদেরুজ্জামান চৌধুরী। সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাদের মিয়া স্যার। আমাদের প্রাণের হ্যাডমাস্টার। সদা গম্ভীর, স্বল্পবাক, মাঝে মাঝে একটু মৃদু হাসি। হাতের লেখা তাঁর কি অপূর্ব সুন্দর! যেন মনেরই প্রতিচ্ছবি। বাংলা যেমন ইংরেজি ও তেমন। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার সময় চকটাকে ঘষে ঘষে একটু চৌকো করে নিতেন। তারপর লেখা শুরু করতেন। আমরা খাতায় তুলে নিতাম। সেই অক্ষরগুলো আজ ও যেন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। অক্ষর অবিনশ্বর। আমার স্যারও তাই। তাঁকে মনে পড়ে। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। সকালের রোদে, বিকেলের ছায়ায়, সন্ধ্যার আধাঁরে, রাতের নির্জনে তিনি তো জেগেই আছেন আমাদের মনোমন্দিরে। তাঁর আদর্শ আমাদের আজো বলে যায়- পার্থিব লোভ থেকে দূরে থাকতে, হিংসা, বিদ্বেষে যেনো ভরে না যায় আমাদের হৃদয়। থানা এডুকেশন অফিসার, ব্যাংক কর্মকর্তার বড় পদ, কোনো কিছুই তাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি শিক্ষকতার মহান ব্রত থেকে। যিনি আলো দেবার জন্যে এসেছেন পৃথিবীতে তিনি যাবেন আবার কোন খানে! বাংলা ব্যাকরণের দুর্বোধ্য বিষয়বস্তুগুলোকে তিনি কত সহজ করেই না বোঝাতেন! ক্লাসের অমনোযোগী ছেলেটিও মন ঢেলে দিতো। তাঁর ইংরেজি ক্লাস তো ছিলো অসাধারণ! অপেক্ষা করতাম একটি বিষ্যুদবারের জন্যে। ঐদিন তিনি Gulliver’s Travels পড়াতেন। কি সুন্দর তাঁর বাচনভঙ্গি। তিনি যেন গালিভারের সাথে আমাদেরকেও দেশ ভ্রমণে নিয়ে যেতেন। যে মানুষটাকে সারা সপ্তাহ দেখতাম গুরুগম্ভীর, স্বল্পভাষী তিনিই আজ একটু মৃদু মৃদু হাসতেন পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে। সাহিত্য রসে তাঁর  মনও ভিজে যেতো। পথশিশুকে নিয়ে  তাঁর লেখা “একটি অনুভূতির জন্ম” আধুনিক কবিতাটি আমি আজো ভুলিনি। একজন প্রশাসককে কৃত্রিম গাম্ভীর্যের একটি আবরণ পড়তে হয়। নয়তো প্রশাসন চালানো  একটু কঠিন হয়ে পড়ে কখনো কখনো। তাঁর বাহিরে ছিল গুরুগাম্ভীর্য, অন্তরে ভালোবাসার ফল্গুধারা। কার বই নেই, কার বেতন দিতে কষ্ট হবে- এসব খবর তিনি রাখতেন নিয়মিত। স্বভাবসুলভ মানবিকতায়। আমার স্যারের ইংরেজির স্ট্যানডার্ড কী তা বুঝেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে। প্রতিটি ভাষার যে আলাদা একটি শৈলি আছে তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায়। তাঁর নোট করে দেয়া ইংলিশ এ্যাপলিকেশনগুলো আজো স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। গালিভারের এইট কন্ডিশন তো আওড়াতে পারি মুখস্ত – কমা, সেমিকোলনসহ। আমি তাঁর তুলনা দেবো কার সাথে, কিসের সাথে! আমি যে ভাষা খুঁজে পাইনে! আমার উপমা, রুপক সবকিছু হার মানবে। তিনি তো আমাদের সক্রেটিস,  আমাদের প্লেটো, আমাদের অ্যারিস্টটল। তিনি তো আমাদের উঁচু উঁচু ইউক্যালিপটাস, আমাদের আইফেল টাওয়ার। আমাদের পথ চলার বাতিঘর। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এই দার্শনিক শিক্ষকরা আর নেই। নেই সেই উঁচু বৃক্ষগুলো, নেই আকাশ ছোঁয়া মিনারগুলো। তাই মুখ থুবড়ে পড়েছে এই দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, মনুষ্যত্ব। বয়সের ভারে তাঁর দেহ এখন কিছুটা নুয়ে পড়া। কিন্তু তাঁর মাথা এখনো উঁচু মানুষের মাঝে। সেই যে বলেছিলাম “আইফেল টাওয়ার!” আইফেল টাওয়ারের মতোই থাকবেন তিনি আমাদের মনেপ্রাণে। আজকাল আমার মনে শঙ্কা জাগে। একটি দুঃসংবাদের অপেক্ষায় থাকি যখনই শুনি স্যার অসুস্থ। যদি হারিয়ে ফেলি আকাশের শুকতারাটিকে, পথ চলব কী করে? যদি হারিয়ে ফেলি আর্দশের প্রতীকটাকে? আল্লাহ তুমি আমার স্যারকে সুস্থ রেখো, দীর্ঘায়ু করো। কাছে কিংবা দূরে থাকি আপনার দেখানো পথটিই হবে আমাদের জীবন চলার পথ।আপনিই আমাদের আইডল, আমাদের আইকন, আমাদের রোল মডেল। জয়তু আমার শিক্ষাগুরু!

লেখক; সাবেক শিক্ষার্থী,

বানীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৮৫ ব্যাচ,
অধ্যক্ষ,পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় কলেজ।
আরও পড়ুন  পুকুরিয়ায় ছাত্রলীগের বৃক্ষরোপণ