Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

চট্টগ্রামের বর্বর রেওয়াজ ; কন্যার বাপের বোবা কান্না

আরিফ উদ্দিন ▪️
চট্টগ্রামের সবচেয়ে বর্বর সংস্কৃতি হচ্ছে মেয়ের শশুর বাড়িতে মেয়ে বাবদ সারা বছর উপঢৌকন পাঠাইতে থাকার বাধ্যবাধকতার চল।।কন্যার বাপ সামর্থ্যে কুলাইতে পারুক বা না পারুক,১২ মাস উপঢৌকন পাঠাইতে হবে।পাঠাইতে না পারলে শশুর বাড়িতে তার মেয়ের থাকাটা এক প্রকার অনাধিকার হয়ে যায়।ঘর সংসার করে,এক ঘর মানুষের জন্য ৩ বেলা রান্না করে,ঘর মুছে,স্বামী-শশুড়-শাশুড়ীর কাপড় ধুয়ে,বাচ্চা প্রতিপালন করে,স্বামী তো বটেই,শশুর শাশুড়ী ও ১৪ ননদের সেবা করে কাজের মেয়ের মতো বান্দী হয়েও ঐ ঘরে তার থাকাটা অনাধিকার হয়ে যায় যদি না কন্যার বাপ সিজনে সিজনে উপঢৌকন পাঠাইতে না পারে।

বিয়ের কথাবার্তার শুরু থেকেই এই ছোটলোকি শুরু হয়। মেয়েকে দেখতে ছেলেপক্ষ কয়েকবার আসবে।একবার আসবে শশুর ও তার ভাই বেরাদার।এরপর জামাই আর তার সাঙ্গ।এরপর শাশুড়িও তার এক পাল জাল।প্রতিবারই মেয়ের বাপকে জমপেশ আয়োজন করতে হয়।হ্যান কোন আইটেম বাদ যাইতে পারবে না।যদি ভুলেও বাদ যায় “এই” দেয় নাই বলে ছোগলাই-বোঝাই শুরু হয়ে যাবে।৩৬ আইটেম দিয়ে খেয়ে পান চিবাইতে চিবাইতে পাশের বাড়ির প্রতিবেশী ও দোকানে গিয়ে নিমকহারামের মতো জিজ্ঞেস করবে “ওয়া ইতারা মানুষ ক্যান?ভালা না?মাইপোয়া ইজ্জত্যে না?

মেয়েপক্ষ ছেলেপক্ষের ঘরে যাইতে পারবে না।গেলেও চোরের মতো এলাকায় গিয়ে খবর নিয়ে আসতে হবে।মারাঠিদের তাঁবুতে গুপ্তচর পাঠানোর মতো কাউকে পাঠিয়ে খবর নিয়ে আসতে হবে পোলা কেমন।আর চট্টগ্রাম মানুষের খাসলত এমন যে মেয়ের ক্ষেত্রে ঐ মেয়ে ফেরেস্তা কিনা সেটা দেখবে,আর পোলার ক্ষেত্রে সাত খুন মাপ।

হাফ-ফুল ফার্নিচার,ফ্রিজ,৫০০-১০০০ বৈরাত,মোটরসাইকেল,নগদ মোটা অংকের টাকা,জামাইয়ের সমস্ত কাপড়,শশুর শাশুড়ীর জন্য কাপড় দিতে হবে।চিংড়ি,গরুর মাংসের আবশ্যকতাসহ নানা পদের আইটেম দিয়ে বিয়ের ভাত খাইওয়াতে হবে।কথা ছিলো ৫০০ মানুষ।কিন্তু খাইতে আসবে ৭০০ জন।বাপরে দাওয়াত দিলে,বাপ পোলারে বলবে,পোলা তার চাচাতোভাই সমেত আসবে।ছেলেপক্ষ হতে দাওয়াত পাইলে লোকজন মনে করে বাড়তি গেলে সমস্যা নাই।কন্যার বাপ বেইজ্জত হলে সেটা কন্যার বাপের দ্বায়।আর মেয়েপক্ষের দাওয়াতে ২ জনের এক জায়গায় ১ জন যায়,মন ছোট হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন  বাঁশখালীতে সড়ক দুর্ঘটনায় সবজি ব্যবসায়ী নিহত

বিয়ের দিন খাওয়ানোর পর মেয়ের সাথে গাড়িতে করে ২-৩ আইটেম ডেকসি মাছ-মাংস ভরে গাড়ির পিছনে দিতে হবে।একটা ঘরের জন্য হাঁড়িপাতিল থেকে শুরু করে বদনা পর্যন্ত যা যা লাগে সব দিতে হবে।

৩ দিন পর মেয়েকে আনতে যেতে হবে।কলা,তরমুজ,যা যা সিজনি ফল আছে ভারে ভারে নিয়ে যেতে হবে,যাতে ১৪ গোষ্ঠীরে বিলাইতে পারে।১৪ গোষ্ঠীও ফকিন্নির মতো বসে থাকে ” তিন দিন্নে নায়রী নিতো কি আইন্নে” খাওয়ার আশায়।এভাবে আবার ৭ দিন পর,১৫ দিন পর,১ মাস পর,৩ মাস পর,৬ মাস পর…।প্রতিবারই কন্যাকে আনতে যাওয়ার সময় ভারে ভারে মৌসুমি ফল,পিঠাপুলি,মাছ,-মাংস দিতে হবে।আর মেয়ে নায়র শেষে শশুর বাড়ি ফেরার সময় আবার মৌসুমি ফল,পিঠাপুলি সাথে দিতে হবে।এভাবে প্রতিবারই।যদি কোন বার কম পড়ে যায়,মেয়ের মন খুব ছোট হয়ে যায়।সে জানে শশুর বাড়িতে কথা ও খোঁটা শুনতে হবে।তাই ধারকর্জ করে হলেও দিতে হবে।দিতে না পারলে অবনত মুখে চোরের মতো ঢুকতে হয় নিজের শশুরবাড়ি।

এভাবে চলতে থাকে সারা বছর।প্রতি মৌসুমে মৌসুমি ফল,মৌসুমি পিঠাপুলি,এক পরিবার খেয়ে ১৪ গোষ্ঠী বিলানোর মতো দিতে হবে।প্রতি রমজানে এক পরিবারের জন্য সমস্ত ইফতারির কাঁচামাল ছোলা,খেজুর,চিনি,নারকেল,দুধ ইত্যাদি দিতে হবে,সবকিছু ১০-১৫ কেজি করে।ঈদের সময় জামাই,শশুর শাশুড়ী,দেবর,ননদ,ননদের বাচ্চাকাচ্চাসহ সবার জন্য কাপড় দিতে হবে।ঈদের পর বেড়াইতে আসলে কত করে সালামি দিলো সেটাও গুণবে।শবে বরাত,ক্বদর ও অন্যান্য ফাতেহার সময় মাংস দিতে হবে।অনেক সময় কাঁচা মাংস চেয়ে বসে শশুরবাড়ির লোকজন।কোরবানির সময় বিয়ের ১ম কয়েক বছর ছাগল দিতেই হবে।এরপর কাঁচা মাংস।অনেক সময় ছাগলটা কোরবানি না করে পালন করে বিক্রিও করে দেয় ছোটলোকের বাচ্চাগুলো।

মেয়ে গর্ভবতী হলে “আঁ~দি” নামে এক চল আছে।মাছ,মাংস,পিঠাপুলি,ফলসহ এক গাড়ি নিয়ে মেয়ের শশুর বাড়ি যেতে হয়।বাচ্চার জন্মের পর বাচ্চার জন্য কাপড়,কাঁথা,দোলনা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছু মেয়ের বাপকে দিতে হবে।এছাড়া পান,তেলের বোতল,হ্যানথ্যান কতকিছু,নাপিতের জন্য লুঙ্গি,ধাত্রীর জন্য শাড়ি এসব মেয়ের বাপকে দিতে হবে।কার পোলার বউকে বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে কত বেশি জিনিস দিছে,কত বড় দিছে,কত ঘন ঘন দিছে, এসব নিয়ে প্রতিবেশী ও গোষ্ঠীর মধ্যে বলাবলি হয়,টিপ্পনী মারা হয়।১২ মাস জালে-জালে প্রতিযোগিতা হয়,প্রতিবেশীর সাথে প্রতিযোগিতা হয়,গোষ্ঠীর বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়।এই প্রতিযোগিতায় বলি হয় কন্যা ও কন্যার বাপ।

আরও পড়ুন  একুশে ফাউন্ডেশন এর ৬ষ্ঠ বর্ষপূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠান সম্পন্ন

এভাবে চলতে থাকে বিয়ের পর অন্তত ১০-১৫ বছর।ছেলেপক্ষের লোকজন যখন খুশি যতজন মেয়ের বাপের বাড়িতে বেড়াইতে আসতে পারবে,থাকতে পারবে,সবাইরে জামাই আদর করতে হবে।আদর আপ্যায়নে যাতে কমতি না হয়।কমতি হলে মেয়ের উপর নানা ফর্মে অপমান নিপীড়ন চলবে।কিন্তু মেয়ের বাপের বাড়ির লোকজন ছেলের বাড়িতে বেড়াইতে গেলে আদর আপ্যায়নের কোন গ্যারান্টি নাই।দিলে দিলো না দিলে নাই।কিছু বলা যাবে না।অনেক সময় মেয়ের বা বাচ্চার অসুখ হলে শশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়,যাতে মেয়ের বাপই চিকিৎসার ভার বহন করে।

বিয়ের কথাবার্তার শুরু থেকে বিয়ের পর সমস্ত সময়েই এখানে ছেলেপক্ষ সব দিক দিয়ে সুপ্রীম-সুপিরিয়র, আর মেয়েপক্ষ সর্বদা অবনত এবং নতজানু।

এখানে ২টা পরিবারের মধ্যে আত্মার বন্ধন হয় না।বলা যায় একটা অসম চুক্তি হয়।যেখানে কন্যা ও কন্যার বাপ শুধুই দিতেই থাকবে।কন্যার বাপ নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য কিছু কিনতে না পারুক,খাইতে না পারুক,কর্য করে,জমি বন্ধক দিয়ে হলেও মেয়ের শশুর বাড়ির লোকজনকে সন্তুষ্ট করতে হবে,না হয় শশুরবাড়িতে তার কন্যা যে অসহায় হয়ে যাবে এটা সে জানে।

একজন বাপের জন্য কন্যাসন্তানের মতো সুন্দর ব্যাপার ২য়টা হয় না।কিন্তু চট্টগ্রামে কারো ঘরে মেয়ে হলেই বাপসহ ঐ পরিবারের সবার মন ছোট হয়ে যায় উপরের নোংরা সংস্কৃতির কারণে।পরপর কন্যা সন্তান জন্ম দিতে থাকলে,মা’কে অপমানিত হতে হয়,বাপকেও হাটবাজারে অপমান করে।আরো কত মধ্যযুগীয় বর্বর ব্যাপার দেখে চট্টগ্রামে আমার বড় হওয়া।

ঈদ আসছে। না জানি কত মেয়ে নিজের শশুর বাড়িতে পর হয়ে বাপের তৌফিকহীনতার গ্লানি নিয়ে যাদেরকে আপন করে নিয়েছে তাদের দ্বারা অপমানিত হতে হতে লজ্জায় অবনত হয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদে।আর কন্যার বাপ! নিজের জীবনভাগ্য ও সামর্থহীনতার দ্বায় মাথায় নিয়ে তার ফুলমুখী কন্যার অসহায়ত্বের কথা ভেবে চাপা কান্নায় বলে মা! তোর বাপকে ক্ষমা করিস।

লেখক, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।