Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বাঁশখালীর ইতিহাস ; ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক তথ্য (২য় কিস্তি)

ডক্টর আবদুল করিম (ইতিহাসবিদ)

(১ম কিস্তির পর) (বাঁশখালীর ইতিহাস) হয় ঐ স্থানগুলির অস্তিত্ব তখন ছিল না, বা নামগুলির অস্তিত্ব থাকলেও ঐ স্থানগুলি গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায় ঐগুলি মানচিত্রে স্থান পায় নি। তবে দ্য ব্যরসের মানচিত্রের বৈশিষ্ট্য হলো স্থানের নামের স্বল্পতা এবং সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রাম তখন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এই মানচিত্রে স্থানের স্বল্পতা দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, এই এলাকায় আবাদী কম হওয়ায় এবং জনবসতি কম থাকায় জনপদের নামও বেশি ছিল না, চট্টগ্রাম ইংরেজদের অধিকারে গেলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে আবাদের প্রমাণ পাওয়া যায়। ইংরেজদের রেকর্ডপত্রে দেখা যায় যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোক সরকারের অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঝোঁপ জঙ্গল পরিস্কার করে চাষাবাদ করতো, এই সকল আবাদী জমিকে নোয়াবাদ বলা হতো। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ভূমি রেকর্ডে নোয়াবাদ ভূমির আধিক্য দেখা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্য ব্যরস মানচিত্রে জনবসতি যেরূপ কম দেখা যায়, এই বিস্তীর্ণ এলাকায় সেরূপ কম বসতি হওয়া যুক্তি সঙ্গত নয়। দ্বিতীয়, দ্য ব্যরস বাংলার ইতিহাস লিখেন নি, তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এতদঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মপ্রচার এবং পুর্তগীজদের ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করা। যেই সকল স্থান এই বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না, সেই গুলির নাম দেওয়া তিনি প্রয়োজন বোধ করেন নি। এই দ্বিতীয় কারণেই ব্যরসের মানচিত্রে স্থানের নামের স্বল্পতা রয়েছে বলে মনে হয়।’

দ্য ব্যরসের মানচিত্রের প্রায় একই সময়ে ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তুরস্কের সুলতান সোলায়মানের লোহিত সাগরস্থ নৌ বাহিনীর এ্যাডমিরাল সিদী আল- চেহলভী “মুহীত” নামক একখানি বই লিখেন। মুহীত শব্দের অর্থ সমুদ্র, অর্থাৎ বইখানি সমুদ্র যাত্রার বিবরণ। এই পুস্তকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌ-চলাচল সম্পর্কে তথ্যাদি পাওয়া যায় এবং বিশেষ করে আরাকান উপকূল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় নৌ-চলাচলের একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। এই উপকূলেই বাঁশখালী অবস্থিত। সিদী আল-চেহলভী এই উপকূলে যেই সকল স্থানের নাম দেন তার মধ্যে রয়েছে দরদিউ, ফেশত হাইউমিউন, বাকাল, কাকরুদিউ, যেনজিলা এবং ফেশত গোরিয়ান। আমি এই বিবরণ পরীক্ষা করে স্থানগুলির পরিচিতি দেওয়ার চেষ্টা করেছি, তবে সঠিক পরিচিতি যে দিতে পেরেছি, তা জোর করে বলা যায় না। গত সাড়ে চারশ বৎসরে উপকূলের যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সিদী আল-চেহলভীর বিবরণ অনুসরণ করলে মনে হয় যে সিদী বর্ণিত যেনজিলা বর্তমান বাঁশখালীর উপকূলে অবস্থিত ছিল। যেনজিলা বোধ হয় অংগার খালীর জন্য ব্যবহৃত এবং ফেশত গেরিয়ান বোধ হয় বর্তমান আনোয়ারা থানার গহিরা।

আরও পড়ুন  বাঁশখালীতে সড়ক দুর্ঘটনায় সবজি ব্যবসায়ী নিহত

অতএব দ্য ব্যরসের মানচিত্রে বা সিদী আল-চেহলভীর বিবরণে বাঁশখালীর নাম পাওয়া যায় না। এর পরে আমরা পাই ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দলিল-দস্তাবেজ এবং রেকর্ড পত্র। স্মরণীয় যে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে নবাব মীর কাসিম বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেন। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কোম্পানির কর্মকর্তা চট্টগ্রামের শাসন ভার গ্রহণ করে। কোম্পানির রেকর্ডেই সর্বপ্রথম বাঁশখালী নাম পাওয়া যায় এবং এ সকল রেকর্ডে বাঁশখালীর নাম বনকলি, বনসকলি ইত্যাদি বিভিন্নভাবে লিখিত হয়েছে। বনকলি বা বনসকলি বাঁশখালীর বিকৃতরূপ, কোম্পানির রাইটার বা কেরানিরা অজ্ঞতা বশতঃ এই দেশের অনেক স্থানের নাম বিকৃত করার প্রমাণ পাওয়া যায়। অতঃপর মৌলবী হামিদ উল্লাহ খানের আহাদীস উল-খাওয়ানীনে বা চট্টগ্রামের ইতিহাসে বাঁশখালী নাম লিখিত হয়।

১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার জন্য চট্টগ্রামকে নয়টি চাকলায় বিভক্ত করে”, যেমন (১) নিজামপুর, (২) ভাটিয়ারী (৩) আওরঙ্গাবাদ, (৪) নোয়াপাড়া (৫) রাঙ্গুনীয়া, (৬) চক্রশালা, (৭) দোহাজারী, (৮) বাঁশখালী এবং (৯) দেয়াঙ। লক্ষ্য করা যেতে পারে যে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে চারিটি চাকলা স্থান পেয়েছে, এইগুলি চক্রশালা যা বর্তমান পটিয়া থানার সঙ্গে অভিন্ন; দোহাজারী যা বর্তমান সাতকানিয়া থানার সঙ্গে অভিন্ন; দেয়াঙ যা বর্তমান আনোয়ারা থানার সঙ্গে অভিন্ন এবং বাঁশখালী (যা বর্তমান বাঁশখালী থানার সঙ্গে অভিন্ন) আরও লক্ষ্য করার বিষয় যে একমাত্র বাঁশখালী ছাড়া অন্য কোন চাকলার নাম বর্তমান থানার নাম অনুসারে হয় নি। সাতকানিয়া এবং বাঁশখালীর দক্ষিণে, অর্থাৎ বর্তমান কক্সবাজার জিলায় কোন চাকলা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ইহার কারণ বোধ হয় এই যে, ঐ এলাকা প্রায় অনাবাদী ছিল এবং ঐ এলাকায় মগদের বেশ উৎপাত ছিল। মগদের উৎপাতের ফলে কক্সবাজার এলাকায় জনজীবনে স্বস্তি ছিল না এবং এই কারণে চাষাবাদও কম ছিল। কোম্পানি ঐ এলাকা এবং কর্ণফুলীর দক্ষিণস্থ চাকলাগুলি বেশি করে আবাদ করার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জনগণকে আবাদ করার উৎসাহ দেয় এবং যারা আবাদ করবে, তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এই কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জিলায় প্রচুর নোয়াবাদ জমি দৃষ্ট হয়। নোয়াবাদ অর্থ নোয়া আবাদ বা নতুন করে আবাদ কৃত, অর্থাৎ ঐ জমি কোম্পানি আমলের প্রথম দিকে আবাদ হয় বা চাষোপযোগী হয়। অতঃপর ঐ এলাকা দ্রুত আবাদ হতে থাকে এবং অল্পদিনের মধ্যে ঐ এলাকা কক্সবাজার জিলা) কোম্পানির রাজস্ব ব্যবস্থার অধীনে আসে। প্রকৃতপক্ষে সারা দক্ষিণ চট্টগ্রামেই আবাদী ছিল কম এবং জনসংখ্যা খুব বেশি ছিল না। কোম্পানির উপরোক্ত চাকলা ব্যবস্থায় বিভিন্ন চাকলার রাজস্বও নির্ধারিত হয়, চক্রশালার রাজস্ব ৩৫,০০০ টাকা, দোহাজারীর ৫৫,০০০ টাকা, দেয়াঙ ৫০,০০০ টাকা এবং বাঁশখালীর ৩৫,০০০ টাকা। রাজস্বের অংকেই বুঝা যায় আবাদী এবং জনবসতি কিরূপ কম ছিল।

আরও পড়ুন  ড. আবদুল করিম স্মরণ

উক্ত চাকলা ব্যবস্থায় সকল চাকলার সীমা নিধারণ করা হয়েছে। বাঁশখালীর সীমা দেওয়া হয়েছে, উত্তরে সাঙ্গু নদী, পূর্বে পাহাড় এবং পশ্চিমে সমুদ্র। দক্ষিণের সীমা দেওয়া নাই, অর্থাৎ দক্ষিণে আবাদী না থাকায় বা কম হওয়ায় দক্ষিণের সীমা দেওয়া হয় নি। তবে দক্ষিণ চট্টগ্রাম অর্থাৎ বর্তমান কক্সবাজার জিলা রাজস্ব ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি করে বাঁশখালীর বর্তমান দক্ষিণ সীমা স্থির হয়। অতএব আঠার শতকের শেষার্ধে আমরা বাঁশখালীর সীমারেখা পাই, তবে ধারণা করা অমুলক হবে না যে বাঁশখালীর এই সীমারেখা মোগল আমলেও বলবৎ ছিল কারণ ইংরেজ শাসকেরা পূর্ববর্তী আমলের ভৌগোলিক সীমারেখা হঠাৎ করে পরিবর্তন করার পক্ষপাতী ছিল না। বাঁশখালীর সীমারেখা অপরিবর্তনীয় থাকার একটি বড় কারণ এই যে বাঁশখালীর তিনদিকেই প্রাকৃতিক সীমারেখা, অর্থাৎ পাহাড়, নদী এবং সমুদ্র। শুধু দক্ষিণ দিকেই হয়ত কিছু পরিবর্তন হতে পারে।

নদী পথে বাশখালীর মধ্য দিয়ে পর্তুগীজ পাদ্রি ম্যানরিকের রামু ও রামু হয়ে আরাকান যাওয়ার কথা এই অধ্যায়ে পরে এবং তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সিস বুকানন নামক একজন ইংরেজ বাঁশখালী আসেন। প্রকৃতপক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ট্রেডের নির্দেশক্রমে তিনি চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা ভ্রমণ করেন। এই অঞ্চলে মসলা উৎপাদনের সম্ভাব্যতা জরিপের দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়।

ইহা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন, এবং তাঁর প্রণীত রিপোর্ট পূর্ব ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে বিশেষ সহায়ক, তবে সেই বিষয়ে এখানে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক নয়। সে যাই হউক তিনি ২১শে মার্চ ১৭৯৮ তারিখে চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা থেকে সকাল ৫ টায় বের হয়ে প্রথমে কর্ণফুলী নদী পার হন এবং পরে পায়ে হেঁটে ১০ টার সময় চাঁদপুর ঘাটে পৌঁছেন। এখানে তিনি বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হন। আগের দিনে তিনি কয়েকজন অনুচর পাঠালেও তারা অনেক কষ্টে এবং অনেক দেরিতে বুকাননের নদী পার হওয়ার জন্য নৌকা যোগাড় করতে সমর্থ হয়, এবং বেলা ৩ টা পর্যন্ত তারা সকলেই অভুক্ত থাকে। বুকানন এই অসুবিধার দুইটি কারণ নির্দেশ করেন; ১ম তাঁর অনুচরগণ হয়তো ইংরেজ সাহেবের দোহাই দিয়ে বিনা পয়সায় নৌকা এবং খাবার সংগ্রহের চেষ্টা করে; ২য় এই দেশের লোকেরা বিদেশি শাসকদের ঘৃণার চোখে দেখে। বুকানন দ্বিতীয় কারণটিই অধিকতর সত্য বল মনে করে। দ্বিতীয় কারণ সত্য হলে বলতে হয়ে যে আমাদের দেশের লোকেরা তখনও বেশ স্বাধীনচেতাই ছিল। শঙ্খ নদী পার হয়ে বুকানন পাহাড়ের মাটি দেখে দেখে চুড়ামনি পর্যন্ত যান এবং সেখান থেকে দুরদূরির ভিতর দিয়ে সাতকানিয়ায় প্রবেশ করেন এবং দক্ষিণে কক্সবাজার মহিষখালী পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে যান। বাঁশখালী পাহাড়ে (তিনি বারবার চুড়ামনি পাহাড় বলেছেন) এবং উপত্যকায় তিনি পান, তামাক পাতা, মরিচ (লঙ্কা) এবং তরিতরকারির চাষ দেখেন। তিনি বন্য জন্তুর এবং ধান চাষের কথাও লিখেন এবং শেষে মন্তব্য করেন যে এই এলাকা মসলা চাষের উপযোগী নয়। বুকাননের লেখাতেই আমরা জানতে পারি যে তাঁর পূর্বে মিঃ বার্ড নামক আর একজন ইংরেজ পুকুরিয়ায় নীল চাষ করেন, কিন্তু নীল উৎপাদন লাভজনক না হওয়ায় উহা পরিত্যাক্ত হয়। (চলমান)
 শেষ কিস্তি পড়ুন

আরও পড়ুন  সেঁউতি; আদি কৃষি উপকরণ