ডক্টর আবদুল করিম (ইতিহাসবিদ)
উপরে বাঁশখালী থানার সীমারেখার ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া গেল, আরও জানা গেল যে পর্তুগীজ এবং ইংরেজরা নিজের প্রয়োজনে অতীতে বাঁশখালীতে আগমন করেছিল। কিন্তু বাঁশখালীর নামকরণের কোন তথ্য পাওয়া যায় না তবে এই বিষয়ে কয়েকটি কিংবদন্তী বা জনশ্রুতি শোনা যায়। এইগুলো নিম্নরূপ:”
১নং কিংবদন্তী: বাঁশখালী পাহাড়ের পূর্বে সাতকানিয়া থানা অবস্থিত। কথিত আছে যে ঐ এলাকায় ২ ভাই ও ১ বোনের এক পরিবার ছিল। বোনটির বিয়ে হয় পাহাড়ের পশ্চিমে, অর্থাৎ বাঁশখালী থানায়, সে সেখানে স্বামী সহ জমি আবাদ করে বসবাস করতে থাকে। পরবর্তীতে পৈত্রিক সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ভাই বোনে বিবাদ হয় এবং বিবাদের এক পর্যায়ে উভয় পক্ষে মারামারি শুরু হয়ে যায়। বোনের পক্ষ এই মারামারিতে প্রচুর বাঁশ ব্যবহার করে, বাঁশখালীতে বাঁশ উৎপন্ন হতো এবং বাঁশ ছিল সহজলভ্য। তারা বাঁশ কেটে বাঁশ বন উজাড় করে ফেলে। ভাই এর পক্ষের লোকেরা তখন বলতে থাকে যে বোনের পক্ষের লোকেরা অর্থাৎ বিরোধী পক্ষরা বাঁশ কেটে খালি করে দিয়েছে। এইভাবে বাঁশ খালি বলতে বাঁশখালী নামের উৎপত্তি।
বর্তমানে পশ্চিম বাঁশখালীর গুণাগরী গ্রামে আদম বাদশার বাড়ি নামে একখানি বসতবাড়ি আছে। এই আদম বাদশার বাড়ির পূর্ব পুরুষেরা বাঁশ খালি করে বাঁশখালী নামের উৎপত্তির কারণ বলে দাবি করে। ঐ বংশের লোকেরা বলে যে বোনের স্বামী ঐ এলাকায় আদি বসতি স্থাপনকারী হিসাবে আদম বাদশা নামে অভিহিত হতো।
কিংবদন্তীনং ২: কথিত আছে যে, বাঁশখালী এলাকায় প্রথম জরিপ চলা কালে এক জায়গায় খুঁটি স্বরূপ একটি বাঁশ পুঁতে রাখা হয়। ঐ বাঁশ দূর থেকে দেখা যাওয়ার জন্য একটি কাক মেরে, বাঁশের আগায় বেঁধে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ঐ সীমায় গিয়ে দেখা যায় যে বাঁশের আগায় কাকটি আর নেই, তখন একে অপরকে বাঁশ খালি বলে জানায়। জরিপের লোকেরা বাঁশ খালি বলতে বলতে বাঁশখালী নামের উৎপত্তি হয়।
কিংবদন্তীনং ৩: সাতকানিয়া থানার বাজালিয়ায় সাঙ্গু নদীর তীরে মরহুম মৌলানা শরফ-উদ-দীন- বেহাল (রঃ)-এর মাজার দৃষ্ট হয়। জনশ্রুতি মতে ঐ বেহাল সাহেব মযযুব ছিলেন এবং মগদের সঙ্গে তাঁর বৈরীতা ছিল। আরও শোনা যায় যে তিনি জোর করে মগ মহিলাদর নিকট থেকে দুধ পান করতেন। মগেরা তাঁর প্রতি বিরক্ত হয়ে তাঁকে হত্যা করে, কিন্তু দেখা গেল তাঁর মুণ্ড কয়েকবার ছিন্ন করা হলেও তিনি আবার সুস্থ হয়ে উঠতেন। তাই আর একবার মনগরা তাঁর মুণ্ড ছিন্ন করে মুণ্ডটি নিয়ে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে আসে। সমুদ্র তীর থেকে জেলেরা ঐ মুণ্ড উদ্ধার করে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখে যে মুণ্ডটি তাজা, তাই তারা মুণ্ডটির দেহের খোঁজ নেয়ার উদ্দেশ্যে একটি বাঁশের উপর লটকিয়ে রাখে। অপরদিকে মুণ্ডহীন দেহটি কয়েকদিন যাবত তরতাজা থাকায় বাজালিয়া বাসী কিছু মুসলমান, এবং এমনকি কিছু মগও ছিন্ন মুণ্ডটির খোঁজে সমুদ্র উপকূলে আসে। মুণ্ডটির খোঁজ পেলে উভয় পক্ষে বিরোধ বাধে, প্রত্যেক পক্ষই সম্পূর্ণ শরীরটি (মুণ্ড এবং দেহ) রেখে দিতে চায়। শেষ পর্যন্ত ফয়সালা হয় যে পরের দিন সকাল পর্যন্ত যদি শিরটি বাঁশের উপরেই থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে দেহটি নিয়ে এসে শিরের সঙ্গে সমুদ্র উপকূলে দাফন করতে হবে, আর যদি শিরটি রাত্রের মধ্যে বাঁশ থেকে পড়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে যে শিরটি দেহের সঙ্গে মিলিত করে বাজালিয়ায় দাফন করতে হবে। উভয় পক্ষের লোক সারারাত পাহারা থাকে এবং সকালে দেখে যে বাঁশটি খালি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এবং মুণ্ডটি পাশে এমনভাবে বসে আছে যে যেন একটি সুস্থ শিশু বা মুণ্ড বসে আছে। অতএব শিরটিকে বাজালিয়ায় নিয়ে দেহের সঙ্গে একত্রে দাফন করা হয়। বাজালিয়ায় তাঁর মাজার অত্যন্ত সম্মানিত। রাস্তার পাশে ঐ মাজার অতিক্রম করার সময় রিক্সাওয়ালা আরোহী নামিয়ে দেয়। সম্প্রতি তার নামে বাজালিয়া হাইস্কুলের নাম বাজালিয়া শরফুদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় করা হয়। সমুদ্র উপকূলের এলাকায় বাঁশের খুঁটি থেকে শিরটি পড়ে বাঁশ খালি করে দেয়ার দিন থেকে বাঁশখালী নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। বাজালিয়ার প্রায় সকল বয়স্ক লোক এই কথাটি বিশ্বাস করে।
উপরোক্ত তিনটি কিংবদন্তীর তৃতীয়টি অলৌকিক বা অতি লৌকিক ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, এইরূপ ঘটনার সঙ্গে যুক্তি খাটে না, অথচ ইতিহাস যুক্তি নির্ভর। ঘটনাটি সত্য হতে পারে আবার নাও হতে পারে, বাঁশখালীর নামের উৎপত্তির সঙ্গে ইহার সম্পর্ক আছে কিনা তাও জোর করে বলা যায় না। দ্বিতীয় কিংবদন্তীর যৌক্তিকতা থাকতে পারে, তবে এই কিংবদন্তীতে কোন্ জরিপের কথা বলা হয়েছে? ইহা যদি ইংরেজ আমলের জরিপ হয় তাহলে ইংরেজ আমলের আগেই বাঁশখালী নামের উৎপত্তি হয়েছে, সুতরাং কিংবদন্তী সত্য হতে পারে না। জরিপ শব্দটি ফারসি, মুসলমান আমলে জরিপের প্রচলন হয় এবং মুসলমান আমলে বিভিন্ন স্থানে জরিপ করে জমির খাজনা নির্ধারণ করা হয়। তবে মুসলমান আমলে বাঁশখালীতে জরিপ হয় কিনা বলা যায় না, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে মনে হয় বাঁশখালীতে মুসলমান আমলে জরিপ হওযার সম্ভাবনা কম। তাই দ্বিতীয় কিংবদন্তীটি বিশ্বাস করার পথে বাধা রয়েছে।
প্রথম কিংবদন্তীটি বাঁশ কেটে খালি করে দেয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত, কিংবদন্তী সত্য হউক বা না হউক, বাঁশ এবং খালি বা খালী এই দুই শব্দের সমন্বয়ে বাঁশখালী নামটি গঠিত। বাঁশখালীতে আগে প্রচুর বাঁশ উৎপন্ন হতো, এখনও হয়, তবে আগের তুলনায় অনেক কম। বাঁশ আমাদের জনজীবনে অতি প্রয়োজনীয় জিনিস, ঘর বাঁধায় এবং গৃহস্থালী ও কৃষি কাজ বাঁশ ছাড়া চলে না, বাঁশের কাজ করে অনেকে জীবিকা অর্জন করে। মোগল আমলে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাঙালিরা বাঁশ ও মাটির সাহায্যে দূর্গ তৈরি করতো, দূর্গের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে পরিখায় বাঁশের ছুঁচালো ফলা পুঁতে রাখতো, যাতে প্রতিপক্ষের সৈন্য এবং হাতি সহজে পরিখা অতিক্রম করে দূর্গ দখল করতে না পারে। আসাম কোচবিহারে বাঁশের বেড়া দিয়ে বর্ষাকালেও রাস্তায় নির্বিঘ্নে মানুষ এবং গরু ও মহিষের গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা হতো। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাঁশের চোঙ্গার ভিতরে কাগজ বা দলিলপত্র সংরক্ষণ করা হতো অর্থাৎ বাঁশকে ফাইলের কাজে ব্যবহার করা হতো; বাঁশের ভিতরে টাকা জমিয়ে বাঁশকে ব্যাঙ্কের কাজে ব্যবহার করা হতো। আমাদের দেশে এখনও বাঁশের সাহায্যে পুল এবং বাঁশের বেড়ার সাহায্যে কালভার্ট (ছোট ছোট পুল) তৈরি করা হয়। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বড়শির ছিপ, বাঁশের চাই, লুই দ্বারা মাছ ধরা হয়, বাঁশের লাই, খাঁচা, চুরা, কনটেনার বা পাত্র, বাক্স, নৌকায় বাঁশের ছই, পাটাতন ইত্যাদি এবং এইরূপ আরও অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। সুতরাং বন সম্পদ এবং বাঁশ শুধু বাঁশখালী কেন, সারা বাংলা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখে। খালী ফারসি শব্দ, আমরা যেই অর্থে খালি শব্দ ব্যবহার করি, অর্থাৎ শূণ্য, খালি করা ইত্যাদি, ফারসি খালী শব্দের অর্থও তাই। বাঁশের মত একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস খালি হয়ে যাওয়া বাঁশখালীর জনগণের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আর্থিক বিপর্যয়ও বটে। তাই বাঁশ খালি হওয়া থেকে বাঁশখালীর নামকরণ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।