
সাধনপুরে বিশুদ্ধ কোরআন শিক্ষার পথিকৃৎ মাষ্টার আলহাজ্ব জাকের হোছাইন চৌধুরীর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ….
বাঁশখালী উপজেলার পশ্চিম সাধনপুর শেখ বদল মুন্সীর বাড়ি। এছাড়া লোকমুখে এ বাড়ির নাম ফাতেয়াবর বাড়ী (ফাতেমা থেকে ফতেয়া)/মৌলভীর বাড়ী/ ইন্সপেক্টর আহমদ হোসেন চৌধুরী বাড়ী/ মাষ্টার ওমর চৌধুরী বাড়ী নানান নামে পরিচিত। সম্ভান্ত্র এই বংশের জনাব ওয়াহেদ খাঁ চৌধুরীর পুত্র ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী (আর, এস খতিয়ানে লিপিবদ্ধ) আর এই ছৈয়দুর রহমান চৌধুরীর ৯ পুত্র ১ কন্যা। সন্তানদের মধ্যে কনিষ্ট পুত্র জাকের হোছাইন চৌধুরী।
সার্টিফিকেট অনুসারে উনার জন্মসাল ০১.০৭.১৯২৯ ইংরেজী। তিনি ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বানীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রবেশিকা পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান নৌবাহিতে যোগদান করেন।
১৯৫৫ সালে আনোয়ারা উপজেলার উত্তর বরুমচড়া গ্রামের থানাদার বাড়ীর মরহুম ওবেদুছ ছালামের দ্বিতীয় কন্যা নুরুন নাহার বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরে জন্ম নেয় ৫ পুত্র ও এক কন্যা,
১ম পুত্র রেজাউল করিম জন্মের ১ বছরের মধ্যেই মারা যান। পুত্র সন্তান মারা যাওয়ায় তিনি ব্যথিত হন। আল্লাহর কাছে চান যে আর একটা পুত্র সন্তান আল্লাহ দান করলে তাকে কোরানে হাফেজ বানাবেন। আল্লাহ দোয়া কবুল করলে বড় ছেলে তারেককে করাচীতে হাফেজীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করান। সেখানে তিনি এক বজুর্গ ব্যক্তি পাকিস্তানের আল্লামা ফুলপরী (রহঃ) পীর সাহেবের কাছে নিজেও সহী বিশুদ্ধ অর্থসহ কোরআন তেলোওয়াত আস্থত্ব করেন।
বড় ছেলে কোরানে হাফেজ, মেঝ ছেলে একজন আলেম (দাওরায়ে হাদিস) আর সেজ ছেলে মাস্টার তৈয়ব চৌধুরী পুকুরিয়া নাটমুড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক, ছোট ছেলে পড়াশোনা শেষ করে প্রবাসে রয়েছেন,, উনার চার সন্তানেরই জন্ম পাকিস্তানে।
পবিত্র হজ্ব পালনের তীব্র আকাঙ্খা ও আল্লাহর সাহায্য কামনার ফলস্বরুপ ১৯৭০ সালে পানির জাহাজে করে সরকারী ব্যবস্থাপনায় পবিত্র হজ্ব পালন করেন ও মদিনা শরীফে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) এর রওজায়ে মোবারক জিয়ারত লাভ করেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার বাঙ্গালীদের বন্দী করেন। সে হিসেবে তিনি বন্দী ছিলেন। জেলখানায় তিনি সাড়ে চার হাজার বাঙ্গালীদেরকে সহী কোরান তেলোওয়াত ও নামাজ শিক্ষা দিতেন। তিন বছর বন্দী থাকার পর বন্দী বিনিময় হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালীদের দেশে নিয়ে আসেন। ৩রা মার্চ ১৯৭৪ সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। চাকুরীকালীন সময়ে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিভ্রমণ করেন।
তার বিদেশ ভ্রমনের তালিকাভুক্ত দেশসমূহ নিম্নরূপ—
সিরিয়া,,মাল্টা – ১৯৫৪ – ৫৫
আমেরিকা – ১৯৫৬ – ৫৭
ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন – ১৯৬০
লিবিয়া, মিশর – ১৯৫৭
সৌদি আরব – ১৯৭০
(সার্ভিস বুক থেকে সংগৃহীত)
তিনি বাংলা, উর্দু, ইংরেজী ও আরবী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
নৌবাহিনীতে যোগদানের পূর্বে তিনি সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন জুনিয়র হাই স্কুলে (বর্তমান সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে) শিক্ষকতা করেন। নন্দী বাড়ীর প্রয়াত দুলাল নন্দী ডাঃ রহিম উদ্দিন প্রমুখ ঊনার ছাত্র ছিলেন।
অবসরের পর সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কৃষিকাজ এর পাশাপাশি বাজারে পুরাতন কাপড় বিক্রি ও একটি ছোট মুদির দোকান করতেন। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি পাড়ার ছেলে মেয়েদের সকাল বেলায় অবৈতনিক সহী কোরআন শিক্ষা দিতেন, বাড়ীর কাচারীতে কাঠের দরজা বোর্ড হিসাবে ব্যবহার করে আরবী হরফগুলো শিখাতেন।
১৯৭৭ সালে তাঁর বড় ভাই ইন্সপেক্টর আহমদ হোছাইন চৌধুরী, মোহাম্মদ হাফেজ ও এলাকার গণ্যমান্য অনেককে সাথে নিয়ে সাধনপুর আনোয়ারুল উলুম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক হিসেবে থাকার সুবাদে তিনি বর্তমান প্রজন্মের অত্র এলাকার সকল আলেম সমাজের শিক্ষাগুরুর মর্যাদা লাভ করেন। এছাড়া তিনি ১৯৮৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি বেসরকারী কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন, তাঁর পাঠদানের বিষয় ছিল বাংলা, ইংরেজী ও গণিত। মাদ্রাসাগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ বৈলগাঁও কনজুমুল উলুম মাদ্রাসা (বাঁশখালী), বাইঙ্গাপাড়া বড় মাদ্রাসা (বাঁশখালী), হাইলধর মাদ্রাসা (আনোয়ারা), কোয়ালী মাদ্রাসা (আনোয়ারা), মদুনাঘাট মাদ্রাসা (রাউজান) এবং সর্বশেষ (১৯৮৮-২০০২) সাল পর্যন্ত জিরি মাদ্রাসা (পটিয়া)। পটিয়ায় তিনি মাষ্টার সাহেব নামে পরিচিতি লাভ করেন। জিরি মাদ্রাসা থাকাকালীন সময় বিভিন্ন তথ্য ও বার্ষিক রিপোর্ট তিনি ইংরেজীতে লিখতেন।
ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি একজন নীতিবান মানুষ ছিলেন, দুর্নীতিকে কোন দিন প্রশয় দেন নাই। একবার আনোয়ারা হাইলধর মাদ্রাসা থেকে ঊনি মালেশিয়া যাওয়ার জন্য বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসার ৫০০/- (পাঁচশত) টাকা ঘুষ দাবী করলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন এবং উক্ত যাত্রা থেকে বিরত থেকে মাদ্রাসায় চলে আসেন।
২৬ শে সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে আনুমানিক ৯০ বছর বয়সে এই মহান পুরুষ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকাল বাসী হন। তিনি বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য আলেমের উস্তাদ হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’য়ালা এই দ্বীন ও সমাজের খাদেমকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন, আমিন।