Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

হোস্টেল সুপারের হলুদ কম্বলটি

অধ্যক্ষ, মোঃ জাকের হোছাইন

আমি তখন দশম শ্রেণিতে ওঠেছি। থাকি হোস্টেলে। টেস্ট পরীক্ষার পাশাপাশি এস.এস.সি পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিচ্ছি। হোস্টেলের কড়া নিয়ম। ফজরের আযানের সাথে সাথেই ঘুম থেকে ওঠে যেতে হবে। নামায পড়ে স্নান করতে হবে। স্নান করতাম রায় পরিবারের বড় দীঘিতে। একসাথে অনেকে। তারপর ফিরে আসতাম হোস্টেলে। এসেই পড়ালেখা শুরু। একসময় সকালের নাস্তার ডাক পড়তো। ওঠে যেতাম টেবিল থেকে। ডাইনিং রুমে গিয়ে বসতাম। নাস্তা খাওয়া শুরু হতো। নাস্তা মানে সেই আলু ভর্তা ডাল দিয়ে মোটা চালের ভাত। কখনো কখনো ভাতের সঙ্গে সঙ্গী হতো শাক-সব্জি। কখনো ভালো লাগতো, কখনো লাগতো না। মাঝে মাঝে শ্রীপদের দোকানে গিয়ে নাস্তা করতাম। নাস্তা শেষে কেউ প্রাইভেট পড়তে যেতো, কেউ নিজের টেবিলে গিয়ে বসতো। সময় হলে স্কুলে চলে যেতাম। সেই সিঁড়ি বেয়ে, গুটি গুটি পায়ে ওঠে যেতাম ছায়াঘেরা সবুজ ক্যম্পাসে। শুরু হতো এসেম্বলি। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। কেঁপে ওঠতো স্কুল আঙ্গিনা। জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে দেশ ও জাতি গড়ার শপথ নিয়ে চলে যেতাম শ্রেণিকক্ষে। শুরু হতো নিত্যদিনের ক্লাস। দুপুর ছুটিতে চলে আসতাম হোস্টেলে। দুপুরের খাবার শেষ করে আবার স্কুলে, আবার ক্লাসরুমে। এই ফাঁকে কেউ কেউ স্কুল ফাঁকি দেওয়ার মহান কাজটি করে ফেলতো। পরের দিন কি পরিণতি হবে কিশোর মন তা ভুলে যেতো। কোথাও ফুটবল খেলা বা বৈশাখী মেলার গরুর লড়াই থাকলে তো কথাই নেই।
আমার স্কুল জীবনে একটি হলুদ কম্বল আমাকে শাসন করতো। সেই কম্বলের ভিতরে মানুষ থাকুক আর নাথাকুক- আমি ভয় পেতাম। সেই কম্বলটি আমাকে পড়তে বলে, নামাযে যেতে বলে। ঠিক সময়ে নাস্তা করতে বলে। স্নান করতে বলে। সেই কম্বলটি ছিল আমাদের হোস্টেল সুপারের। আমাদের বাংলাটিচার কালাম স্যারের। আমি স্যারের রুমে থাকতাম। আমার আরেকজন রুমমেট ছিল। তার নাম আমান উল্লাহ। বাড়ি চকরিয়া। আমরা দু’জনই টৈটং হাই স্কুল থেকে এসেছি।
তখন শীতকাল। বেশ ঠান্ডা পড়ছে। আদাজল খেয়ে এস.এস.সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ডাইনিং থেকে রাতের ভাতটা তাড়াতাড়ি খেয়ে রুমে চলে আসতাম। লেপ মুড়িয়ে দিয়ে পাঁচ-দশ মিনিট রেস্ট করতাম। কালাম স্যার তখন ডাইনিং টেবিলের একপাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। খাওয়ার সময়ও শাসন। কড়া ডিসিপ্লিন। একটু এদিক ওদিক করার সুযোগ নেই। স্যার রুমে ফিরে আসার আগে দশ মিনিট লেপের ভিতরে কাটাতে পারলেই আমার যতো সুখ, যতো আনন্দ। ঐ আরামের সময়টাতে দরজায় ছিটকিনি লাগানো যেতো না। দরোজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখলেই তো স্যার বুঝে যাবেন আমি কোন শুভ কাজটি করছি। স্যার দরোজায় এসেই ডাক দিতেন- জাকির হোসেন, পড়ছো তো? জী, স্যার, অংক করছিলাম। লেপের দশমিনিটকে লুকানোর জন্য অংকের কথা বলাই নিরাপদ। নয়তো জিজ্ঞেস করবেন- শব্দ হচ্ছিলো না কেন?
স্যার শুয়ে পড়েছেন। হলুদ কম্বলটি মাথা অবধি মুড়িয়ে দিয়েছেন। স্যারের মুখ দেখা যাচ্ছেনা। কম্বলের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে ডাক আসে- জাকির হোসেন, পড়ছো তো? শব্দ শোনা যাচ্ছেনা কেন? জী স্যার, আমি ফিজিক্সের অংকগুলো করছি। সবসময় অংক করলেই হবে? অন্য সাবজেক্ট পড়তে হবেনা? জী, স্যার। স্যারের ঘুম আসার লক্ষণ দেখে আমি টেবিলটাকে নতুনভাবে সাজাই । বইয়ের ওপর বই রেখে টেবিলটাকে এক হিমালয়ের রূপ দিয়েছি। আস্তে করে মাথাটা টেবিলে রেখে ঘুমের মাসী-পিসি সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আমার অর্ধেক ঘুম টেবিলে, অর্ধেক বিছানায়। ঘুমের মাঝে স্যারের নড়াচড়া দেখলে আমান উল্লাহ আমার মাথায় ঝাঁকুনি দিতো। টেবিল থেকে মাথা তুলেই আমি পড়া শুরু করতাম- অ্যাঁ, অ্যাঁ, সবুজের অভিযান, সবুজের অভিযান! রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ!
একদিনের ঘটনা। স্যার একটু আগেভাগে শুয়ে পড়েছেন। আমি একটা প্ল্যান করলাম। আজ রাতে চুপে চুপে ‘অগ্নিবীণা’ পড়বো। কাঠকোঠ্যা পাঠ্যবই পড়তে পড়তে মনটা বিষিয়ে ওঠেছে। বেডের নিচ থেকে বইটি বের করেছি। আস্তে আস্তে পড়া শুরু করেছি। হঠাৎ হলুদ কম্বলটি নড়ে ওঠেছে। আমার পরানে তো পানি নেই। এই বুঝি ধরা খাবো। ভয়ে আমি কাঠ হয়ে গেছি। এতোদিন তো ভালো মানুষের মুখোশ পরে অনেক গল্প-কবিতার বই পড়েছি। আজ বুঝি সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে। ভাগ্যিস, হলুদ কম্বলের ভেতর থেকে কোনো ডাক আসেনি। সারাদিনের পরিশ্রমে স্যার হয়তো খুব ক্লান্ত ছিলেন। আমি রক্ষা পেয়ে গেছি। স্যার কখনো বাইরের বই পড়তে নিষেধ করতেন না। কিন্তু সবকিছুর একটা সময় আছে। কখোন পাঠ্যবই পড়বে, কখোন ‘আউট বই’ পড়বে। কিন্তু কিশোর মন তো এসব মানতে চাইতোনা। যুক্তির চেয়ে আবেগই বেশি থাকে ঐ মনে।
আমাদের সময়ে কিছুদিন কম্বাইন্ড গ্রুপ ছিলো। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য সব মিলিয়ে একটি জগাখিচুড়ি গ্রুপ। পরে অবশ্য গ্রুপগুলো আলাদা হয়ে যায়। কালাম স্যার আমাদেরকে বাংলা ও ইতিহাসের নোট দিতেন। যেদিন নোট দেবেন ঐদিন আমাকে অনেক বই বহন করে স্কুলে নিয়ে যেতে হতো। স্যার কয়েকটা লেখকের বই মিলিয়ে একটা নোট দিতেন। স্যার অনেক পরিশ্রম করতেন আমাদের জন্যে। শিক্ষকরা ক্লাসে নোট দিবেন, এ কথা আজকাল ভাবা যায়না। নোট পেতে হলে প্রাইভেট পড়তে হবে। টাকা দিয়ে স্যারদের পকেট ভর্তি করতে হবে।
নিয়ম-শৃঙ্খলা ও আদব-কায়দার ব্যাপারে স্যার ছিলেন আপোসহীন। এতটুকু ব্যত্যয় ঘটলেই ‘জোরছে মার’ লাগিয়ে দিতেন। বেয়াড়া ছাত্রদেরকে পিটানোর দৃশ্য দেখলে তখন খুব খারাপ লাগতো। মায়া হতো। অনেক সময় স্যারের বিরূদ্ধে অভিমান জাগতো। কিন্তু এখন বুঝি, স্যার কেন এতো মারতেন, কেন এতো বকতেন। তিনি অনুভব করতেন, এই দুরন্ত কিশোরদের অভিভাবক তিনি। তাঁর এতটুকু অবহেলা, উদাসীনতা তাদেরকে বিপথে নিয়ে যাবে। মাঝপথে পড়ালেখার ইতি টেনে জীবন থেকে ওরা হারিয়ে যাবে। তাই তাঁর এই অতন্দ্র পাহারা, এই কঠোর শাসন।
আমিও একজন শিক্ষক। আমার কমিনম্যান্ট আছে শিক্ষার্থীদের কাছে, অভিভাবকের কাছে। সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে। এই অনুভবটি স্যারেরাই বপন করে দিয়েছেন আমাদের মাঝে সেই কৈশোরে। আমি এখনও সেই হলুদ কম্বলটি সরাতে পারিনা চোখ থেকে। সেই কম্বলটি আমায় আজো ডাক দিয়ে বলে- পড়ো, ভালো করে পড়ো। তোমাকে ফার্স্ট হতে হবে। স্ট্যান্ড করতে হবে। অনেক বড় হতে হবে। আমার স্যার এখন বার্ধক্যে জর্জরিত। হাঁটতে কষ্ট হয়, কথা বলতে ও কষ্ট হয়। কিন্তু আমাদের কলেজের এইচ.এস.সির ফল বেরুলেই তিনি নিশ্চিত ফোন করবেনঃ জাকির, ক্যামন আছো? তোমার কলেজের রেজাল্ট কি? যাঁরা শিক্ষক, তাঁরা আজীবনই শিক্ষক। তাঁদের হৃদয়ে অহর্নিশ
জ্ঞানের আলো জ্বলে। তাঁরা সমাজের কথা ভাবেন, রাষ্ট্রের কথা ভাবেন। আমার কালাম স্যার আলোকের ঝর্ণাধারায় স্নাত এমনই একজন শিক্ষক, এমনই একজন গুরু। আমার ইচ্ছে হয়, এ প্রজন্মের শিক্ষকদেরকে সেই হলুদ কম্বলটি পরিয়ে দিই। তাঁরা লেখাপড়ার উষ্ণতা নেবেন ঐ কম্বল থেকে। শাসনের সাথে সোহাগের শিক্ষাটিও গ্রহণ করবেন অন্তর দিয়ে। কিছুটা হলেও মুক্তি পাবেন দায়িত্বহীনতার দায় থেকে। জয় হোক আমার কালাম স্যারের। জয় হোক তাঁর শাসন ও ভালেবাসার। লেখক- অধ্যক্ষ, পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় কলেজ

লেখক, অধ্যক্ষ ;পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রী কলেজ ও সাবেক শিক্ষার্থী বানীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়। (১৯৮৫ ব্যাচ)
আরও পড়ুন  বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসনের জাতীয় শোক দিবস পালন