Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বাঁশখালী কলেজে আমার অধ্যয়নকাল

বাঁশখালী উপজেলার অন্যতম কীর্তিমান সন্তান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সদ্য অবসোরত্তর ছুটিতে যাওয়া অধ্যাপক ও সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডীন প্রফেসর চৌধুরী মোহাম্মদ আলী লিখেছেন বাঁশখালী কলেজে তাঁর অধ্যয়নকাল নিয়ে।

বাঁশখালী কলেজে আমার অধ্যয়নকাল ছিল দুই শিক্ষাবর্ষঃ ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬ সাল। ১৯৭৪ সালের এস, এস, সি, পরীক্ষার্থী ছিলাম। কিন্তু উপর্যুপরি বন্যার কারণে ঐ বছরের পরীক্ষাটা বার বার পিছাচ্ছিল। অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ পেলাম। ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো এবং আমি এস, এস, সি, পাশ করলাম। পরের বছরের শুরু থেকেই বিভিন্ন কলেজে এইচ, এস, সি, ক্লাশের ১ম বর্ষে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। বন্ধু-বান্ধবদের অনেকই ভালো কলেজের খোঁজে শহরে পাড়ি জমাল। আমরা যারা তুলনামূলক অসচ্ছল পরিবারের ছিলাম, তারা গ্রামের বাড়িতে থেকেই যতদূর সম্ভব পরবর্তী উচ্চশিক্ষা অভিযান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তদনুযায়ী ১৯৭৫ সালের শুরুতেই বাড়ির নিকটবর্তী বাঁশখালী কলেজেই ভর্তি হয়ে গেলাম। বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব ছিল প্রায় সাড়ে তিন মাইল। পায়ে হেঁটেই কলেজে যেতে হতো।

প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পাওয়ায় এবং ক্লাশের সব পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করায় স্কুলে থাকাকালে ভালো ছাত্র হিসেবে আমার বেশ একটা সুনাম থাকলেও এস, এস, সি, পরীক্ষার রেজাল্টে তার তেমন একটা প্রতিফলন ঘটে নি। ফলে আমি সহ অভিভাবক, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক ও শুভানুধ্যায়ী সবাই একটু আশাহতই ছিলাম। যাহোক, পঁচাত্তরের কোন এক শীতের সকালে বাবা আমাকে নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে গেলেন ভর্তি করিয়ে দিতে। সেদিনের সেই সুখময় স্মৃতির কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। বাবা আমাকে নিয়ে প্রথমেই গেলেন আহাদ স্যারের কাছে এবং পরিচয় করিয়ে দিলেন। উল্লেখ্য যে আহাদ স্যার (অধ্যাপক আবদুল আহাদ) আমাদের পূর্ব পরিচিত এবং আত্মীয় ছিলেন। স্যার আমাদেরকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করলেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পাদনের নির্দেশ দিলেন। ভর্তি ফরম পূরণকালে আমাকে মানবিক বিভাগ নির্বাচন করতে দেখে আহাদ স্যার আমাকে বিজ্ঞান বিভাগের কথা ভেবে দেখতে বললেন। যেহেতু স্যার আমাকে ভালো ছাত্র হিসেবে জানতেন, তাই অন্যসব ভালো ছাত্রের মতো আমাকেও বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার পরামর্শ দিলেন। আমি অবশ্য মানবিক বিভাগেই ভর্তি হয়েছিলাম। কারণ আমি মানবিক বিভাগে এস, এস, সি, পাশ করেছিলাম। এখানে উল্লেখ্য যে যদিও গ্রুপ বা বিভাগ নির্বাচন সাধারণতঃ নবম শ্রেণীতে করা হতো, আমাদের বেলায় সেটা সম্ভব হয়নি কারণ আমাদের চাঁপাছড়ী গ্রামের যে স্কুল থেকে আমরা এস, এস, সি, পাশ করেছি (যেটার নাম ছিল পশ্চিম বাঁশখালী হাই স্কুল”), সে স্কুলে আমাদের সময়ে শুধু মানবিক বিভাগই ছিল। অন্য দুটো বিভাগ যথাক্রমে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য তখনো আমাদের স্কুলে চালু হয়নি। ফলে সবাইকে বাধ্য হয়ে মানবিক বিভাগেই পড়তে হতো। অবশ্য পার্শ্বরবর্তী কালিপুর ও বাণীগ্রাম স্কুলে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে পড়ার সুযোগ ছিল। একাদশ শ্রেণীতে বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ থাকলেও শ্রদ্ধেয় আহাদ স্যারের সুপরামর্শ সত্বেও আমি তা করার সাহস করি নি।

আমাদের সময়ে বাঁশখালী কলেজ ছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি নতুন কলেজ। মাত্র ৭/৮ বছর আগে ১৯৬৭ সালে এলাকার কিছু বিদ্যোৎসাহী লোকের একান্ত আগ্রহ ও অক্লান্ত পরিশ্রমে বাঁশখালী উপজেলায় সর্বপ্রথম এই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু হলেও কলেজটি তখনো গড়ে উঠার ক্ষেত্রে একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। অনেক কিছুতেই তখনো অপূর্ণতা বিরাজমান। ভৌত কাঠামো ছিল খুবই দুর্বল। ফলে কক্ষ ও আবাসন সংকট ছিল প্রকট। একটি মাত্র দ্বিতল পাকা ভবন ছিল, যেটার নির্মাণকাজ তখনো শেষ হয় নি । আর ছিল কয়েকটি টিন ও বাঁশের তৈরি ঘর, যার একটি মেয়েদের কমন রুম এবং অন্যগুলো শ্রেণীকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নির্মাণাধীন পাকা দালানটির একাংশে ছিল অধ্যক্ষের কক্ষ, অফিস-কাম-লাইব্রেরি আর শিক্ষকদের বিশ্রামাগার। অপর অংশে ছিল বিজ্ঞান গবেষণাগার এবং কমন ক্লাশরুম। উত্তর দিকে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে ছিল টিন আর বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি একটি লম্বা ঘর, যেটি শিক্ষকদের ডরমিটরি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ডরমিটরির সোজা দক্ষিন-পশ্চিমে একটি ইবাদৎখানা ছিল, যেখানে ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছাত্র-শিক্ষকরা নামাজ আদায় করতেন। কলেজের মূল পাকা ভবনের পূর্বদিকে কয়েক কক্ষ বিশিষ্ট একটি আধপাকা টিনের ঘর ছিল, যেটাকে দূর-দূরান্ত থেকে আসা কিছু ছাত্র হোস্টেল হিসেবে ব্যবহার করতো। এক কথায়, সামনের প্রকৃতি-প্রদত্ত সুপরিসর খেলার মাঠটি ছাড়া উল্লেখ করার মতো কলেজের আর কিছুই ছিল না। অধিকন্তু সবকিছুতেই তখনো অপূর্ণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

আরও পড়ুন  সরলে মৎসজীবীদের মাঝে চাল বিতরণ

অনেক বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা ছিল না আর অত্যাবশ্যকীয় বিষয়সমূহেও সর্বদা শিক্ষক স্বল্পতা বিরাজ করতো। মফস্বলের কলেজ হওয়াতে শিক্ষকরাও দীর্ঘদিন থাকতে চাইতেন না, শহরের বা তার কাছে-কিনারের কলেজে সুযোগ পেলেই চলে যেতেন। আমাদের স্বল্পকালীন অধ্যয়নকালে অনেকগুলো বিষয়ে আমরা একাধিক শিক্ষকের পাঠগ্রহণে বাধ্য হয়েছি। এভাবে শুরু থেকেই কলেজটিতে অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকদের আসা-যাওয়া চলছিল। আমরা যখন ১৯৭৫ সালের শুরুতে কলেজে ভর্তি হই তখন অধ্যক্ষ ছিলেন জনাব জসিম উদ্দিন হায়দার চৌধুরী। সুদর্শন ও সুবক্তা এই ভদ্রলোক কানুনগোপাড়া কলেজের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওখান থেকে এসে তিনি এই কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। কলেজের পাশে গুনাগরিতে একটি বাসায় সপরিবার থাকতেন। কলেজের কার্যক্রম সকাল দশটা থেকে শুরু হলেও উনি কখনো দু-টার আগে কলেজে আসতেন না। ফলে নতুন কলেজের পাঠদান কার্যক্রমের কোন খোঁজ-খবর তিনি রাখতেন বলে মনে হয় না। কলেজে অবশ্য উনার অবস্থানকাল খুব একটা দীর্ঘ ছিল না। উনাকে নিয়ে শিক্ষক-ছাত্রদের তীব্র মতানৈক্য একদিন ক্যাম্পাসে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিলে ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে তিনি কলেজ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। উনার চলে যাওয়ার পর থেকে অধ্যাপক আবদুল আহাদ স্যার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। অধ্যাপক আবদুল আহাদ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অত্যন্ত সজ্জন ও জ্ঞানী এই মাটির মানুষটি তাঁর বিনয় এবং বিনম্র স্বভাবের জন্য ছোট-বড় সবার কাছে সমাদৃত ছিলেন। আমাদের সময়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন দু-জন ঃ অধ্যাপক ইউসুফ জাফর এবং অধ্যাপক দীপক কুমার বড়ুয়া। দু-জনই সফল ও জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। জাফর স্যার আমাদের গদ্যাংশ পড়াতেন আর দীপক স্যার পড়াতেন কবিতাংশ। দীপক স্যারের সুললিত কন্ঠে কবিতাপাঠ এখনো আমাদের অনেকের কানে বাজে। ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করতেন প্রথম দিকে অধ্যাপক সনজিত মিত্র এবং অধ্যাপক আহসানুল হক। আমাদের দ্বিতীয় বর্ষে বাবু সনজিত মিত্র চলে গেলে অধ্যাপক জহির উদ্দিন ইংরেজির অধ্যাপক পদে যোগ দেন। খুব সম্ভবতঃ বাঁশখালী কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি এই কলেজ থেকে এইচ, এস, সি, পাশ করেছিলেন। আহসানুল হক স্যার আমাদের প্রথমদিকে কবিতা এবং পরে প্রবন্ধ পড়িয়েছিলেন। জহির স্যার আমাদের কবিতা পড়াতেন। দু-জনই সজ্জন ছিলেন এবং পরিশ্রম সহকারে পাঠদানের চেষ্টা করতেন। আমাদের পৌরনীতির শিক্ষক ছিলেন প্রথমদিকে অধ্যাপক দিদারুল আলম। ব্যতিক্রমি পাঠদান পদ্ধতির কারণে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের অধ্যয়নকালের মাঝমাঝি সময়ে তিনি নাজির হাট কলেজে চলে যান। উনার চলে যাওয়ার পর ঐ পদে যোগ দেন অধ্যাপক রেজাউল করিম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েই তিনি এই কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনিও অবশ্য আমাদের অধ্যয়নকালেই অগ্রণী ব্যাংকে অফিসার পদে চাকরি নিয়ে চলে যান। ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন প্রথমদিকে কবির সাহেব নামের এক ভদ্রলোক। বেশ চটপটে ও জনপ্রিয় অধ্যাপক ছিলেন তিনি। তাঁর প্রস্থানের পর ঐ বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক মিয়া আবদুল মোতালিব। বেশ পরিশ্রমী ও স্নেহবৎসল শিক্ষক ছিলেন আবদুল মোতালিব স্যার। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই স্নেহ করতেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েই এই কলেজে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন। আমাদের যুক্তিবিদ্যার স্যার ছিলেন অধ্যাপক মনিন্দ্রনাথ সরকার। অসম্ভব অমায়িক ও স্নেহবৎসল এই স্যার খুবই শিক্ষার্থী-বান্ধব ছিলেন। পিতৃসুলভ আদর আর স্নেহে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখতেন। পড়া-লেখায়ও ছিলেন চৌকস। উনার সযত্ন শিক্ষাদানের কারণে যুক্তিবিদ্যা বিষয়টি আমাদের সবার কাছে একটি অতি প্রিয় বিষয় ছিল। ভালো-খারাপ সব শিক্ষার্থীর ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখতেন স্যার। কলেজের কাছেই আশ্রম এলাকায় উনাদের বাসা ছিল, যেখানে আমরা ছাত্ররা বেশ কয়েকবার সদলবলে হানা দিয়েছি। স্যারের সহধর্মিণী অধ্যাপিকা সুচিত্রা রায়ও আমাদের শিক্ষক ছিলেন। ম্যাডাম আমাদের অর্থনীতি পড়াতেন। আরো দুই জন শিক্ষক আমাদের অর্থনীতির ক্লাশ নিতেন। একজন আহাদ স্যার, যাঁর কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আর একজন ছিলেন অধ্যাপক ফজলুরল করিম। ফজলুল করিম স্যার খুবই রসিক প্রকৃতির লোক ছিলেন। উনার রসবোধ ছিল বেশ প্রবল। বিভিন্ন চুটকি আর কৌতুকের মাধ্যমে তিনি নীরস অর্থনীতির ক্লাশকে বেশ উপভোগ্য করে তুলতেন। তিনি অবশ্য পরে শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে মুন্সেফ হিসেবে বিচার বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন  বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে হয়ে প্রাণ গেল কারখানা শ্রমিকের

মানবিক বিভাগের এই কয়জন শিক্ষকের বাইরে আরো অনেক শিক্ষক ছিলেন যাঁরা বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে ক্লাশ নিতেন। উনাদের কোন ক্লাশে উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার কখনো হয় নি। আমাদের সময়ে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক হিমাংসু বিমল ভট্টাচার্য্য। রসায়ন শাস্ত্র পড়াতেন অধ্যাপক বাসুদেব পালিত। গণিতের অধ্যাপক ছিলেন বাবু হরিকৃষ্ণ আচার্য্য। বিজ্ঞান বিভাগে উদ্ভিদ বিদ্যারও একজন শিক্ষক ছিলেন, যাঁর নামটা এমুহূর্তে মনে পড়ছে না। বাণিজ্য বিভাগে হিসাব বিজ্ঞান পড়াতেন অধ্যাপক জালাল আহমদ। ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন বাবু চিন্তাহরণ দত্ত এবং নিহার কান্তি সেন। এছাড়া আরো কয়েকজন শিক্ষক হয়তো বিভিন্ন সময়ে স্বল্পকালের জন্য নিয়োজিত ছিলেন, যাঁদের নাম জানা সম্ভব হয় নি। বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষকদের সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটতো পরীক্ষার হলে উনাদের পরীক্ষা পরিচালনা ও তদারকির সময়। এঁদের মধ্যে দু-জনের খুব সুখ্যাতি ছিল পরীক্ষার হলে নকল প্রথা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে।

সময়টা ছিল স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশের। সারা দেশে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবক্ষয় নেমে এসেছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও তা থেকে কোনভাবে মুক্ত ছিল না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছিল সশস্ত্র মহড়া আর পরীক্ষার হলগুলোতে ছিল নকলের মহোৎসব। সে সময়ে পরীক্ষার হলে ছাত্র-ছাত্রীদের অসদুপায় অবলম্বনে বাধা দেয়া সত্যিই দুরূহ ও কঠিন ছিল। ফলে হলে ছাত্র-ছাত্রীদের অসদুপায় অবলম্বনে বাধা দেয়া বা হাতে-নাতে ধরা অনেক শিক্ষকের কাছে রীতিমতো বীরত্বের ব্যাপার ছিল। এক্ষেত্রে আমাদের সময়ে বাঁশখালী কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে দুই জনের বেশ নাম-ডাক ছিল। একজন অধ্যাপক নিহার কান্তি সেন অপর জন অধ্যাপক বাসুদেব পালিত।
এই ক্ষেত্রে কলেজগুলোতে কর্মরত শিক্ষকদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। মফস্বলের কলেজগুলোতে কর্মরত শিক্ষকমন্ডলীর মন-মানসিকতাও খুব একটা সুস্থ প্রকৃতির ছিল, তাও কিন্তু বলা যায় না। কারণ তখন সারাদেশে বেসরকারী কলেজগুলোর চিত্র অনেকটা একই রকম ছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নতুন কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট বিরাজ করতো, সব সময় যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যেত না। ফলে এমন কিছু শিক্ষককে কলেজে নিয়োগ দেয়া হতো যাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বৈশ্বিক পরিবেশে অধ্যয়নের প্রত্যক্ষ কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। এঁদের অনেকই হয়তো পূর্বে গ্রামের কোন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এবং পরে অনিয়মিত (প্রাইভেট) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এঁদের সংকীর্ণ মানসিকতা কলেজের মতো অপেক্ষাকৃত বৃহৎ পরিবেশে এসে খুব একটা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় নি, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁদের সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনা ও কাজে। উদাহরণ স্বরূপ তাঁদের অনেকই বিশ্বাস করতে পারতেন না যে মফস্বলের কোন পাবলিক পরীক্ষায় কেউ নকলমুক্তভাবে অংশ গ্রহণ করতে পারে। আর এটাও অনেকের বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে মফস্বলের কোন কলেজ থেকে কোন শিক্ষার্থীর পক্ষে ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বৈশ্বিক পরিবেশে অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যে উদার উপলব্ধি ঘটে এবং উন্নত মানসিকতার বিকাশ হয়, সেই সুযোগ নিয়োজিত অনেক শিক্ষকের উল্লিখিত কারণে হয়ে উঠে নি। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে একপেশে ও সংকীর্ণ মনোভাবের কোন পরিবর্তন হয় নি, ঘটে নি জীবন ও জগৎ বিষয়ে উদার মানসিকতার পরিপূর্ণ বিকাশ এবং উপলব্ধি। এঁদের অনেকই পরবর্তীকালে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গিয়ে আমার মনে হয় শুধু নিজের প্রতি নয়, দেশের প্রতি-ও সুবিচার করেছিলেন।

আরও পড়ুন  শনিবার শেখেরখীল বনাম কাথরিয়া মহারণ

আগেই উল্লেখ করেছি, বাঁশখালী কলেজ বাঁশখালী উপজেলার প্রথম কলেজ যা গুনাগরি গ্রামের পাহাড়ের পাদদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে অবশ্য ২/১ বছরের ব্যবধানে থানা সদরে ”আলাওল কলেজ” নামে আরো একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফলে আমাদের সময়ে বাঁশখালীর উত্তরাংশের ছেলে-মেয়েরাই প্রধানতঃ বাঁশখালী কলেজে ভর্তি হতো। একইভাবে আমাদের স্কুল থেকে পাশ করা আমরা একই এলাকার অনেকই সে বছর কলেজে একই ক্লাশে ভর্তি হয়েছিলাম। বন্ধুদের অনেকই অনেক দূর থেকে প্রায় ৫/৬ মাইল পথ পায়ে হেঁটে কলেজে আসা-যাওয়া করতো। আমরা যারা একই পথে এক সঙ্গে নিয়মিত কলেজে যাওয়া-আসা করতাম তাদের মধ্যে সামসুল আলম, আবদুল মাবুদ, কাসেম, আবুল হোছাইন, ইদ্রিছ, নুরুল আলম প্রমূখের নাম এখনো বেশ মনে আছে। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য স্কুল থেকে পাশ করা আরো অনেকই আমাদের সহপাঠী ছিল। তাদের মধ্যে চাঁপাছড়ী গ্রামের কফিল, গুনাগরির কামাল, গফুর, কাসেম, সেলিম, খুরশিদ ও রহিম, কালিপুরের হেলাল ও ডেজি, কাথারিয়ার জাফরুল, চেচুরিয়ার কৃষ্ণা, রিনা ও রত্না, কোকদন্ডির নীলিমা, শোভা ও প্রতিকা, সাধনপুরের মালেক এবং রায়ছটার সালামের কথা এই মুহূর্তে বেশ মনে করতে পারছি। এর বাইরে আরো অনেকই ছিল যাদের নাম স্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।

আজ থেকে ৪৫/৪৬ বছর পূর্বে এই কলেজে আমার যারা সহপাঠী ছিল তাদের অনেকই আজ বেঁচে নেই। আর যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের সবাই এখন ষাটোর্ধ অবসর জীবন যাপন করছে। ঠিক এমন একটা বয়সে যখন অতীতের দিকে তাকাই, তখন উপলব্ধি করতে পারি কী অপরিসীম অবদান ছিল আমাদের পত্যেকের জীবনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটির। সেদিন বাঁশখালীর মতো এক অনুন্নত জনপদে এই কলেজটি না থাকলে হয়তো আমাদের অনেকের জীবন ভিন্ন দিকে মোড় নিত। এই কলেজটির প্রতি আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য। আমরা এলাকাবাসী বাঁশখালী কলেজের কাছে চিরঋণী।

লেখক : প্রাক্তন ছাত্র, বাঁশখালী কলেজ, (১৯৭৫- ১৯৭৬)