Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

জাদুকরের মতো মুগ্ধতা দিয়ে ইংরেজি শেখাতেন বাঁশখালীর যে শিক্ষক

মুহাম্মদ আরিফ উদ্দীন▪️

সময়টা তখন ২০১০ সালের মাঝামাঝি।আমি তখন জলদীর বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়তাম।অষ্টম শ্রেণীতে উঠেই শুনলাম দেশে প্রথমবারের মতো অষ্টম শ্রেণীতে জে.এস.সি পরীক্ষা চালু হচ্ছে,তাও আমাদেরকে দিয়েই শুরু।জীবনের প্রথম আসন্ন বোর্ড পরীক্ষার কথা ভেবে এক অনিচ্ছায়তা ও ভয়ে থাকতাম।যদিও গণিত  আর বিজ্ঞান আমার পছন্দের ছিলো,পারতাম ভালো,আর বাকি সাবজেক্টগুলো সময় দিলেই পারা যাবে,কোন সমস্যা হবে না,পড়লেই বুঝবো এমন আত্মবিশ্বাস সর্বদা কাজ করতো।কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধলো ইংরেজি নিয়ে।কি করা যায়!!
সিক্স সেভেনে পার্টস অফ স্পিচের সংজ্ঞা, হাতেগোনা কিছু উদাহরণ,আর টেন্সের স্ট্রাকচার  ছাড়া তেমন কিছু পড়া হয় নি,যা পড়ছি বেশিরভাগই এক প্রকার না বুঝেই মুখস্থ করা।ক্লাস এইটে যে ভয়েস,রাইট ফর্ম অফ ভার্ব,ন্যারেশন,এপ্রোপ্রিয়েট প্রিপজিশন,কমপ্লেটিং সেন্টেন্সের মতো বাঘা বাঘা সব দুর্বোধ্য গ্রামার আইটেম,এই যে মুখস্থ করলে চলে না।রুল বুঝে করতে হয়।চৌধুরী এন্ড হোসাইনের ৬০০ পৃষ্ঠার ইয়া মোটা বই,তুখোড় কঠিন কঠিন শত শত শব্দের ভোকাবুলারি বলা দীপন স্যার যার পড়া না পারলে হাতের আংটিসমেত মাথায় টনিয়া খেতে হতো,অনুপম স্যার মাঝেমধ্যে এসেই মুখ ঠোঁট অদ্ভুতরকমভাবে বাঁকিয়ে কঠিন কঠিন ইংরেজি জটিল শব্দের উচ্চারণ শেখাতেন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতন করে।আর ইসমাইল স্যার যিনি গ্রামারের একটা রুল পড়ানোর পর,ঐ রুলের ব্যতিক্রম রুল,সাব-রুল,রুট-রুল,একই রুল কিন্তু অন্যরকম,বইয়ে নাই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হরেকরকম ক্যাটাগরির রুল লিখে যখন আবিষ্কার করতেন বোর্ডে আর জায়গা খালি নাই,তখন ১০ সেকেন্ড সময় দিতেন লেখার জন্য,তারপর আবার শুরু,আবার এক বোর্ড লেখা,আরেকবোর্ড,তারপর আরেকবোর্ড।
অসহায় নির্বোধ বালক ফটিক হয়ে ভাবতাম ইংরেজি কি তাহলে ব্রিটিশদের পোর্ট উইলিয়াম দূর্গের চেয়েও দুর্বোধ্য,আমরা কি তাহলে দুদু মিয়া কিংবা তিতুমীরের মতো অসহায় আত্মসমর্পণ করবো ইংরেজি ভাষাটার কাছে,এটা কি ইংরেজদের ২০০ বছরের শাসনের চেয়েও যন্ত্রণার।গানের লিরিক্সে বলতে গেলে সখি গ্রামার কারে কয়,সে কি শুধু যাতনাময়।

আরও পড়ুন  প্রাথমিক ও হাইস্কুল শিক্ষকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে স্কলারশিপ এর সুযোগ

তারপর একদিন কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার ভাষায় রবীন্দ্রনাথের মতো দীপ্ত পায়ে হেঁটে ক্লাসে আসলেন মধ্য বয়স্ক গেরুয়া রং এর দাড়ির একজন স্যার।

হাসিমুখে থাকিয়ে কথা বলতেন বন্ধুর মতো,কাছে এসে হেঁসে হেঁসে বুঝতে চাইতেন আমার রোগটা কোথায়,এই যে আমি জানি না,বুঝি না ঠিক আছে,কিন্তু সে না বুঝা বা না জানার গভীরতা আসলে কতদূর,কত গভীর আমার দূর্বলতা,বন্ধুর মতো অভয় দিয়ে কথা বলতেন,জানার চেষ্টা করতেন আমার অজ্ঞতার শেষ কোথায়।আমিও স্যারকে বন্ধুর মতো পেয়ে নিজের অজ্ঞতা মেলে ধরলাম।স্যার বুঝলেন কোথা থেকে কিভাবে শুরু করতে হবে।তারপর গল্পের মতো করে টেন্স,ভয়েস,ন্যারেশন,কমপ্লেটিং সেন্টেন্স শেখাতে লাগলেন।অদ্ভুত উদাহরণ দিয়ে আগে আগ্রহ জমাতেন,তারপর আমাদের আইডিয়া কি শুনতে চাইতেন,এরপর আমাদের আইডিয়ায় কোথায় গলদ আছে বুঝাতেন,তারপর সুন্দর করে দুগ্ধবাচ্চার কাছে ফিডার খাওয়ার মতো রুলসটা বুঝিয়ে দিতেন,যা আপনি না বুঝতে চাইলেও বুঝতে বাধ্য,যা আপনি হয়তো ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারবেন না,যার ক্লাসে আপনি মনোযোগ না দিতে চাইলেও না দিয়ে পারবেন না,স্যারের বাচনভঙ্গি আপনার মনোযোগ টানবেই।
যার অবিরল উচ্ছল হাসিমুখ দেখে প্রশ্ন করার সাহস পেতাম,যার সহজ সাবলীল বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে অজানা আগ্রহ খুঁজে পেতো সন্তুষ্টি।আনন্দের সাথে স্যার এভাবে দূর করলেন ইংরেজির সব ভয়।বুঝালেন রুলস মুখস্থ করা ছাড়াও নিজের সাধারণ সেন্স কাজ লাগিয়ে কিভাবে শুদ্ধ গ্রামারে বাক্য লেখা যায়।ভুল হলেও স্যার বলতেন ঠিক আছে,চেষ্টা করছো,কিন্তু আমি দেখাচ্ছি কিভাবে আরো ভালো লিখতে হয়।সাহস দিলেন লেখার।তারপর গ্রামার,ভোকাবুলারি সব জায়গায় ফ্লুয়েন্সি আসলো।ইংরেজিকে জয় করলাম।

কৈশোরে   হাইস্কুলের ইংরেজি যদি কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মতো দুর্বোধ্য হয় তাহলে তিনি হবেন একজন ব্রায়ান গ্রিন,যিনি ছোট ছোট করে ভেঙে পড়ে দুর্বোধ্য পাঠ্যকে জয় করতে শেখান,অথবা ছোটবেলায় ইংরেজি শেখা যদি হয় পার্টিক্যাল সায়েন্স ব্যাখা করতে গিয়ে ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের মতো অসহায়,তাহলে তিনি হবেন একজন সুপার ব্রেনের আইনস্টাইন।

কৈশোরের দিকে তাকিয়ে যদি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় একজন শিক্ষকের নাম জিজ্ঞেস করা হয়,তাহলে প্রথমে চোখের পর্দায় ভেসে উঠবেন তিনি।তিনিই ছিলেন আমাদের কৈশোরে স্কুলের সহপাঠীদের কাছে একজন জনপ্রিয় রিচার্ড ফাইনম্যান,রেমন্ড চ্যাম্বারস কিংবা একজন ক্যান সিলবার্ন।

আরও পড়ুন  লোক শিল্পি ডা. মতিলাল এর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী

বলছিলাম বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক রফিক আহমদ চৌধুরী স্যারের কথা।যিনি আজ আমাদের সবাইকে ছেড়ে রবের সান্নিধ্যে চলে গেলেন।করুণাময় আল্লাহ উনার আত্মার মাগফেরাত করুক।স্যারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অটুট ভালোবাসা।

লেখক,

সাবেক শিক্ষার্থী,
বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।