Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আজ মৌলভি সৈয়দ’র ৪৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী

মাওলানা সৈয়দ আহমদ। জন্ম ১৯৪৪ সালের ১১ মার্চ বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখীল লালজীবন গ্রামে। বাবা একরাম আলী সিকদার, মা ওমেদা খাতুন। পরবর্তী জীবনে সারাদেশে পরিচিত হন মৌলভী সৈয়দ নামে। পুঁইছড়ি ইসলামিয়া ফাযিল মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু। এরপর ভর্তি হন ইজ্জতিয়া জুনিয়র হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে। দু’বছর পর ভর্তি হন চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যাবাহী সরকারি মুসলিম হাইস্কুলে। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি জন সিটি কলেজে। ছাত্রাবস্থাতেই শুরু তাঁর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের। কলেজ ছাত্রসংসদের জিএস নির্বাচিত হন। সেই সময় কারান্তরীণ অবস্থায় কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রী পাশ করেন। তিনি ছিলেন একজন দুঃসাহসী ছাত্রনেতা।
অনলবর্ষী বক্তা সৈয়দ আহমদ চট্টগ্রামের প্রয়াত জননেতা জহুর আহম্মেদ চৌধুরীর কাছে রাজনৈতিক দীক্ষায় অনুপ্রাণিত হন। ছাত্রাবস্থায় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য লাভ করেন।
১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি হন মৌলভী সৈয়দ, আর সাধারণ সম্পাদক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ৬৯’ এর গণআন্দোলনে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন তাঁরা। সে সময় অনেক দুঃসাহসিকতার সাথে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ও যুবসমাজকে সংগঠিত করে তোলেন।

চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে একটি অনুষ্ঠানে মৌলভী সৈয়দ আহমদ

অসহযোগ আন্দোলনে তাঁদের নেতৃত্বেই সংগঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৭১ সালের মার্চে গঠিত ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মৌলভী সৈয়দ এবং এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে সমাবেশ করে সিদ্ধান্ত হয় পরদিন লালদীঘির মাঠে জয় বাংলা বাহিনীর মার্চপাস্ট আয়োজনের। একই সাথে সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোর। মৌলভী সৈয়দ বীরদর্পে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আর পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। চট্টগ্রাম শহর গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন মৌলভী সৈয়দ। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে দুর্ধর্ষ এক গেরিলা স্কোয়াড। তাঁর দল ‘মৌলভী সৈয়দ বাহিনী’ নামে পরিচিত ছিল। এই মহান বীরের নেতৃত্বে বড় বড় সফল অপারেশন সংঘটিত হয়। আগ্রাবাদ মিস্ত্রিপাড়ায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহমুদুল হকের পৈতৃক বাড়ি ‘সৈয়দ বাড়ি’ তে (বর্তমানে ভাণ্ডার মার্কেট) তাঁর চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক ঘাঁটিটি ছিল। এই বাড়ি থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। একাত্তরে নৌকমান্ডোদের দুঃসাহসিক অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম কমান্ডার ছিলেন মৌলভী সৈয়দ।

আরও পড়ুন  চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের পক্ষে সরলে ত্রাণ বিতরণ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সেসময়ের চট্টগ্রামের ছাত্র ও যুব নেতারা। পিছনের সারিতে মৌলভী সৈয়দ, বাম থেকে তৃতীয় (দাঁড়িয়ে)।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর মৌলভী সৈয়দ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাঁশখালী সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রদান করেন। তবে পরে মনোনয়ন পরিবর্তন করে বাঁশখালীতে শাহ-ই-জাহান চৌধুরীকে মনোনয়ন প্রদান করা হয়। মৌলভী সৈয়দ দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচনী প্রচারণায় ঝাপিয়ে পড়েন।
ছাত্রাবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। জাতির পিতা মৌলভী সৈয়দকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে আমার মৌলভী সাব বলে ডাকতেন। চট্টগ্রাম এলে তিনি প্রিয় সৈয়দকে সাথে রাখতেন সবসময়। কখনো খবর দিয়ে ঢাকায় নিয়ে যেতেন। তাঁর বীরত্ব ও সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করতেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু বাকশাল ঘোষণা করলে মৌলভী সৈয়দ বাকশাল চট্টগ্রাম জেলার যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যাকাণ্ড মৌলভী সৈয়দ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে সশস্ত্র প্রতিরোধ। চট্টগ্রামে কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। ঝটিকা মিছিল করলেন। চট্টগ্রামে কয়েকটি থানায় আক্রমণও করলেন। এরপর ১৯৭৫ এর নভেম্বরে দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। ৭ নভেম্বর কারাগারে বন্দি অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে নির্মভাবে হত্যা করা হয়। এরপর মৌলভী সৈয়দ ভারতে আশ্রয় নেন। পরে বিভিন্ন সময় এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীসহ পুরো দলটি ভারতে চলে যায়। কয়েকবার তাঁর খোঁজে বাঁশখালীর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।
১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে তিনটি মামলা হয় মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ বিপ্লবী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী পরাজয় হলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ভারতে ক্ষমতায় আসে মোরারজি দেশাইর নেতৃত্বে নতুন সরকার।
১৯৭৭ সালের ৬ আগস্ট মৌলভী সৈয়দসহ তাঁর সহযোদ্ধাদের কয়েকজনকে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে পুশ ব্যাক করা হয়। বাংলাদেশের সীমানার প্রবেশের সাথে সাথে সেদিন মৌলভী সৈয়দ সহ তাঁর সহযোদ্ধারা গ্রেপ্তার হন। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। 

আরও পড়ুন  জাদুকরের মতো মুগ্ধতা দিয়ে ইংরেজি শেখাতেন বাঁশখালীর যে শিক্ষক

সেখানে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়। ১১ আগস্ট বিনা বিচারে মৌলভী সৈয়দকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
নির্মমভাবে হত্যার পর তাঁর লাশ হেলিকপ্টারে করে বাঁশখালীতে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। দীর্ঘ এক মাস পুলিশ দিয়ে কবর পাহারা দেয় সামরিক সরকার, যাতে করে জনগণ এই হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ফুসে উঠতে না পারে।
বীর প্রসবিনী চট্টলার ইতিহাসের বীর নায়ক শহীদ মৌলভী সৈয়দ। অসামান্য দেশপ্রেমের অধিকারী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ভালবাসা নজিরবিহীন। বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর অক্ষয় এক নাম শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ।

সূত্র: দৈনিক পূর্বকোণ, দৈনিক পূর্বদেশ, বাংলানিউজ ও হাসান মনসুর